(বাঁ দিকে) কেরি-ল্যাম্বটন থিয়োডোলাইট (আনু: ১৮০২): সমীক্ষায় বিপ্লব আনা যন্ত্র। সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সৌজন্যে। (ডান দিকে) লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে বিদ্যুৎ-তরঙ্গ নিয়ে আলোচনায় জগদীশচন্দ্র বসু, ১৮৯৬ ।
রঞ্জেন কলে একজন রোগী দেখিতে হইবে— তাহার পৃষ্ঠভঙ্গ হইয়াছে।’ (১৮৯৯) ১৮৯৫-এ রঞ্জন রশ্মি আবিষ্কৃত হওয়ার পর জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সির গবেষণাগারে এক্স-রে ছবি তোলার যন্ত্র তৈরি করেন, সম্ভবত ভারতে সেটাই প্রথম। ডাক্তার নীলরতন সরকার তাই প্রায়ই হাড়-ভাঙা রোগী নিয়ে প্রেসিডেন্সিতে হাজির হতেন।
‘আমি সম্প্রতি একটি অত্যাশ্চর্য্য কৃত্রিম চক্ষু প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইয়াছি। এই চক্ষে অনেক আলো দৃষ্ট হয় যাহা আমরা দেখিতে পাই না।’ (৬ মার্চ ১৯০০) এটিই হল পৃথিবীর প্রথম সেমিকন্ডাকটার (অর্ধপরিবাহী) গ্রাহকযন্ত্র বা তথাকথিত ক্রিস্টাল রেক্টিফায়ার, যা মাইক্রোওয়েভ ধরার কাজে লেগেছিল।
‘আমার নূতন কার্য্যে জানিতেছি যে চেতন ও অচেতনের মধ্যে রেখা ক্রমে ক্রমে অদৃশ্য হইতেছে।’ (১৬ মার্চ ১৯০০) জগদীশচন্দ্র দেখিয়েছিলেন বৈদ্যুতিক, যান্ত্রিক উত্তেজনা এবং বিষ প্রয়োগে ধাতু উদ্ভিদ ও প্রাণীর তন্তু সবই সমভাবে সাড়া দেয়।
‘আমি একটি নূতন কল প্রস্তুত করিয়াছি... জীবনের স্পন্দন যেরূপ নাড়ী দ্বারা বোঝা যায়, সেইরূপ জড়েরও জীবনীশক্তির নাড়ীস্পন্দন আমার কলে লিখিত হয়।’ (৩ মে ১৯০১)
রবীন্দ্রনাথকে লেখা নানা চিঠিপত্রে এই ভাবেই খুঁজে পাওয়া যায় গবেষণাগার আর গবেষণাপত্রের আপাত-শুষ্কতার বাইরের এক বিজ্ঞানীকে। জগদীশচন্দ্রের বিখ্যাত সব আবিষ্ক্রিয়ার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মেলে এই চিঠিতেই। আরও খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায়, ঔপনিবেশিক ভারতে বিজ্ঞানচর্চার জমি তৈরি করতে কী ভাবে পদে পদে বাধার সামনে পড়তে হয়েছে তাঁকে। গভর্নর জেনারেলের হস্তক্ষেপে প্রেসিডেন্সিতে চাকরি পেলেন জগদীশচন্দ্র, ডি পি আই এবং প্রেসিডেন্সির প্রিন্সিপাল খুবই অখুশি। তিন বছর অস্থায়ী পদে অর্ধেক বেতনে ছিলেন, প্রতিবাদে সে টাকাও নিতেন না। শেষে চাকরি পাকা হল। কিন্তু অধ্যাপনার সঙ্গে আবার গবেষণা কেন? প্যারিসে বিজ্ঞানী সম্মেলনে যাওয়া নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নাটক। বিদেশে গিয়ে অন্য বাধা— গভীর অবিশ্বাস বিজ্ঞানীমহলে। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শারীরবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা— বিজ্ঞানের বিবিধ শাখার মধ্যে যে সমন্বয়সূত্রের সন্ধানী ছিলেন জগদীশচন্দ্র, তাতে অনেক পণ্ডিতের গড়ে তোলা অচলায়তনে আঘাত লেগেছিল। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে তাঁর লেখা প্রকাশে বাধা পড়ে, তাঁর বক্তব্য আত্মসাৎ করে কৃতিত্ব নিতে চান অন্য বিজ্ঞানী। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁর গবেষণা স্বীকৃতি পায়, ১৯১৭ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন স্বপ্নের বিজ্ঞানচর্চা কেন্দ্র, আজকের বসু বিজ্ঞান মন্দির।
এক দিকে বসু বিজ্ঞান মন্দির শতবর্ষে পা দিচ্ছে ৩০ নভেম্বর, অন্য দিকে লন্ডনের সায়েন্স মিউজিয়ম থেকে এই সময়েই কলকাতায় এসেছেন দুই প্রতিনিধি। ভারতের স্বাধীনতার সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে সায়েন্স মিউজিয়মে ২০১৭ সালে আয়োজন করা হচ্ছে বড় মাপের এক প্রদর্শনী— ‘ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’। দু’দেশের সরকার ২০১৭-কে চিহ্নিত করেছে ভারত-ব্রিটেন সংস্কৃতি-বর্ষ হিসাবে। প্রদর্শনীর উপকরণ সংগ্রহ করতেই কলকাতায় ঘুরে গেলেন কিউরেটর রতন ভাসওয়ানি এবং কনটেন্ট ডেভেলপার ম্যাট কিম্বার্লি। সম্প্রতি ইনটাক-এর উদ্যোগে ভারতীয় সংগ্রহশালায় আয়োজিত এক আলোচনায় ওঁরা জানালেন, বসু বিজ্ঞান মন্দির, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে তাঁরা প্রদর্শবস্তু সংগ্রহের জন্য কথাবার্তা বলছেন। শুধু জগদীশচন্দ্র নন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু কি সি ভি রামনের কর্মক্ষেত্রও তো কলকাতা! কলকাতাতেই তো সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সূচনা। থাকছে সমীক্ষার যন্ত্র থিয়োডোলাইটও। তবে প্রদর্শনীতে শুধু আধুনিক পর্ব নয়, প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতে বিজ্ঞানচর্চার নানা দিকও তুলে ধরা হবে। থাকছে লন্ডনের বডলিয়ান সংগ্রহে রক্ষিত, পেশোয়ার থেকে পাওয়া সেই বাকশালি পুথি যেখানে প্রথম ‘শূন্য’ অঙ্কটির লিখিত রূপ দেখা যায়, বা হরপ্পা থেকে পাওয়া ওজনের নিদর্শন। এমনকী শেষে থাকছে ই ভি এম মেশিন, অটো কি রকেট প্রযুক্তির নমুনাও। ভারতীয় সংগ্রহশালার অধিকর্তা জয়ন্ত সেনগুপ্ত আশাবাদী, প্রদর্শনীটি পরে আরও বড় আকারে ভারতে দেখানো সম্ভব হবে।
শততম বর্ষে বসু বিজ্ঞান মন্দিরও পিছিয়ে নেই। ৩০ নভেম্বর শততম প্রতিষ্ঠা দিবসে প্রতি বছরের মতো ভাষণ, সম্মাননা ও পুরস্কারের সঙ্গে তারা প্রকাশ করছে জগদীশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ পত্রাবলী। জগদীশচন্দ্রের লেখা চিঠিগুলির নতুন সংস্করণ হল, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের চিঠি, পৃথক খণ্ডে। সবুজ ও গেরুয়া কাপড়ে বাঁধিয়ে বই দুটি একটি বাক্সে রাখা হয়েছে, বিশেষ এই সংস্করণটি নির্মাণের কৃতিত্ব বিশিষ্ট গ্রন্থনির্মাতা নারায়ণ চক্রবর্তীর। দু’জনের চিঠিতে ধরা আছে আশ্চর্য এক পারস্পরিকতার কথা: বিজ্ঞানী চাইছেন কবিকে আন্তর্জাতিক করতে, কবি চাইছেন বিজ্ঞানীকে চূড়ান্ত সাফল্যের অঙ্গনে দেখতে। এত যত্নে এমন সংকলন বোধহয় এই প্রথম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy