Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বিদ্রোহের অজানা গল্প শোনাচ্ছে ‘সিপাহি’র করোটি

ই-মেলটা পড়ে চমকে উঠেছিলেন অধ্যাপক কিম ওয়্যাগনার। সিপাহি বিদ্রোহ? ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ওই সময়টা নিয়েই তো এত দিন ধরে চর্চা করছেন তিনি। লন্ডনের কুইনস মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়ান ওয়্যাগনার।

সংবাদ সংস্থা
লন্ডন শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:৩৭
Share: Save:

‘আমাদের কাছে একটা খুলি আছে। এটা বাড়িতে রাখতে অস্বস্তি হয়। কিন্তু ফেলেও দিতে চাই না। কারণ, এটি সম্ভবত সিপাহি বিদ্রোহের আমলের কোনও ভারতীয়ের। আপনি যদি একবার দেখেন, খুব ভাল হয়।’

ই-মেলটা পড়ে চমকে উঠেছিলেন অধ্যাপক কিম ওয়্যাগনার। সিপাহি বিদ্রোহ? ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ওই সময়টা নিয়েই তো এত দিন ধরে চর্চা করছেন তিনি। লন্ডনের কুইনস মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়ান ওয়্যাগনার। ই-মেলটা পেয়ে কালবিলম্ব করেননি অধ্যাপক। যে বয়স্ক দম্পতি তাঁকে লিখেছিলেন, সটান উপস্থিত হন এসেক্সে, তাঁদের বাড়িতে। গিয়ে দেখেন, চমক আরও বাকি। শুধু খুলি নয়, খুলির ভিতরে রয়েছে ইংরেজিতে লেখা এক চিরকুট। তাতে সবিস্তার লেখা, খুলিটা কার।

কী লেখা ছিল চিরকুটে?

‘এটি ৪৬ তম রেজিমেন্টের বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রির হাবিলদার আলম বেগের খুলি। ১৮৫৭-র বিদ্রোহের অন্যতম পাণ্ডা ছিল সে। যে রাস্তাটি দুর্গের দিকে যাচ্ছে, তার মুখে দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রথমে ডাক্তার গ্র্যাহামকে গুলি করে। তারপর মিস্টার হান্টার, তাঁর স্ত্রী ও মেয়েদের খুন করেছিল এই লোকটা। ৫ ফুট সাড়ে ৭ ইঞ্চি উচ্চতার, ৩২ বছর বয়সি আলম বেগকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না, সে এত ভয়ঙ্কর।’ চিরকুট থেকেই জানা যায়, ১৮৫৮ সালে পঞ্জাবের শিয়ালকোটে (বর্তমানে পাকিস্তানে) প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় বেগকে। কামানের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। খুলিটিকে ‘যুদ্ধজয়ের স্মারক’ হিসেবে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন মৃত্যুদণ্ডের সাক্ষী ব্রিটিশ সেনা অফিসার, ক্যাপ্টেন রবার্ট জর্জ কোস্টেলো।

ঈষৎ লালচে খয়েরি রং। চোয়ালের নীচের হাড়টি নেই। ওপরের পাটির যে-কটি দাঁত এখনও রয়েছে, সেগুলোও নড়বড়ে। চিরকুটে লেখা থাকলেও, খুলিটি যে সত্যিই দেড়শো বছরের বেশি পুরনো, তার তো প্রমাণ পাওয়া দরকার। এসেক্সের দম্পতির অনুমতি নিয়ে সেটি লন্ডনের ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম’-এ নিয়ে আসেন ওয়্যাগনার। পরীক্ষা করে জানা যায়, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের খুলি সেটি। এশীয় বংশোদ্ভূত পুরুষের। ত্রিশের কোঠায় মারা গিয়েছিলেন। খুলিতে একটিমাত্র আঘাতের চিহ্ন। যা বলে দিচ্ছে, মৃত্যুর পরে কোনও ধারাল অস্ত্র দিয়ে দেহ থেকে মুন্ডু আলাদা করে নেওয়া হয়েছিল। চিরকুটে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে তা হলে তো মিলেই যাচ্ছে! কামানের গোলায় উড়িয়ে দিলে সাধারণত তার অভিঘাত দেহের উপরেই পড়ে, খুলিতে নয়।

১৯৬৩-তে কেন্টের ‘দ্য লর্ড ক্লাইড’ পানশালার সেলারে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল খুলিটি। মালিক পানশালার শো-কেসে সাজিয়ে রাখেন সেটি। পরে পানশালার হাতবদল হয়। সেটি কিনে নেন এসেক্সের দম্পতির আত্মীয়। যাঁর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পানশালার মালিকানা আসে এই দম্পতির কাছে। খুলিটি রাখার একটুও ইচ্ছে ছিল না তাঁদের। খোঁজখবর নিয়ে তাঁরা ই-মেল করেন ওয়্যাগনারকে।

ইংরেজ সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কেন্টের পানশালা মালিকের কী সম্পর্ক, তা খুঁজে বার করতে পারেননি ওয়্যাগনার। যেমন কোনও ইতিহাস বইয়ে খুঁজে পাননি আলম বেগ সম্পর্কে কোনও তথ্যও। যে-টুকু ওই চিরকুটে আছে, সে-টুকুই সম্বল করে গবেষণায় নেমে পড়েন। তিন বছরের সেই গবেষণার ফসল তাঁর সাম্প্রতিক বই— ‘দ্য স্কাল অব আলম বেগ’। ওয়্যাগনারের দাবি, চিরকুটে উল্লিখিত ব্যক্তির আসল নাম ‘আলিম’।
উত্তর ভারতের বাসিন্দা। বিদ্রোহের সময়ে কানপুরে মোতায়েন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহি ছিলেন তিনি।

ওয়্যাগনারের কথায়, ‘‘কাহিনির শেষ অঙ্কটি এখনও লেখা বাকি রয়েছে। আমি চাই না, জাদুঘরে কাচের বাক্সে রয়ে যাক খুলিটি। তার থেকে ভারতে ফিরিয়ে সেখানেই সমাহিত করা হোক সেটিকে। ১৬০ বছর পরে এই শান্তিটুকু তো দাবি করতেই পারেন অজানা সিপাহি!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE