Advertisement
E-Paper

ছিল না প্রত্যাশার চাপ, তাই আলোচনা এগোল খোলা মনে

নিজের দেশের সেনা-মৌলবিদের প্রবল চাপ সামলে এক জন পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠানে। সেই প্রধানমন্ত্রীই এ বার তাঁর দেশে চলে এলেন এক ডাকে। মাঝের দেড় বছরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উত্তেজনা চরমে উঠেছে একাধিক বার।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:২৪
পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকে মোদী। এএফপি-র তোলা ছবি।

পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকে মোদী। এএফপি-র তোলা ছবি।

নিজের দেশের সেনা-মৌলবিদের প্রবল চাপ সামলে এক জন পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠানে। সেই প্রধানমন্ত্রীই এ বার তাঁর দেশে চলে এলেন এক ডাকে। মাঝের দেড় বছরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উত্তেজনা চরমে উঠেছে একাধিক বার। কিন্তু আজ দিনের শেষে নরেন্দ্র মোদী এবং নওয়াজ শরিফের হাত ধরাধরি করা ছবিটাই একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করে দিল বলে দাবি করছে দিল্লি।

বারো বছর পরে পাকিস্তানের মাটিতে পা দিলেন কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, মোদী যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন গতি আনতে বদ্ধপরিকর, আজকের সফরই তার প্রমাণ। যে প্রসঙ্গে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ টুইটারে লিখেছেন, ‘‘এটাই রাষ্ট্রনেতার মতো আচরণ। প্রতিবেশীর সঙ্গে এমন সম্পর্কই হওয়া উচিত।’’ ও দিকে, পাক বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র কাজি খলিলুল্লা বলেছেন, ‘‘বিদেশসচিব এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকগুলি ফের শুরু করা নিয়ে প্যারিসেই কথা হয়েছিল দুই প্রধানমন্ত্রীর। তার পরেই ব্যাঙ্ককে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের বৈঠক হয়েছে। ইসলামাবাদে ‘হার্ট অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী। আজকের বৈঠকের পরে দু’দেশই চাইছে দ্বিপাক্ষিক সমস্ত বিষয় নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা শুরু করতে।’’

আজ প্রায় এক ঘণ্টা একান্তে কথা হয় মোদী এবং শরিফের। সেই আলোচনা ইতিবাচক পথেই এগিয়েছে বলে দাবি পাকিস্তানের। ঠিক হয়েছে, সন্ত্রাস-সহ সমস্ত বিষয় নিয়ে আগামী মাসেই দু’দেশের বিদেশসচিব আলোচনায় বসবেন ইসলামাবাদে। বস্তুত, আগামী বছর পুরোদস্তুর পাকিস্তান সফর করার জন্য আজ মোদীকে ফের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন নওয়াজ। সূত্রের খবর, সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন মোদী। ব্যাঙ্ককে নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের বৈঠক ও সুষমার পাক সফরের পর্যালোচনার পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়েও আজ শরিফের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর।

কূটনীতিকদের মতে, মোদীর এই হঠাৎ-সফরের ‘মাস্টার স্ট্রোক’টা অন্য জায়গায়। সরকারি ঘোষিত সফরে দ্বিপাক্ষিক দেনা-পাওনার হিসেব থাকে, যৌথ বিবৃতির শব্দচয়ন নিয়ে ঝড় ওঠে, কাশ্মীর প্রসঙ্গ সেখানে অবধারিত এবং সাংবাদিক বৈঠক করার দায়ও থাকে। কিন্তু আজকের সফরের পরিকল্পনাটাই এমন ভাবে হয়েছিল, যেখানে প্রত্যাশার কোনও চাপ ছিল না দুই প্রধানমন্ত্রীর উপরে।

ইতিহাস বলে, দুই দেশ যত বারই আস্থার পথে হেঁটেছে, তত বারই পাক সেনা-আইএসআই ও মোল্লাতন্ত্র তা ভেস্তে দিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মোদীর সফরে শরিফ এসেছিলেন ২০১৪-র মে মাসে। অগস্টেই হুরিয়তের সঙ্গে পাক হাইকমিশনারের বৈঠকের জেরে সচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করে দেয় ক্ষুব্ধ দিল্লি। ইতিমধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখায় দু’দেশের নিরাপত্তাবাহিনীর গুলি-বিনিময় চরমে ওঠে।

২০১৫-র জুন, জুলাই, অগস্ট— তিন মাস লাগাতার উত্থান-পতন চলে দু’দেশের সম্পর্কে। জুনে মোদী ঢাকায় যান। সেখানে সন্ত্রাসে ইন্ধন দেওয়া নিয়ে পাকিস্তানকে বিঁধে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে আমাদের হাতে ৯০ হাজার পাক যুদ্ধবন্দি ছিল। যদি আমাদের পৈশাচিক মানসিকতা থাকত, তা হলে তখন কী হতো বলা যায় না।’’ এই মন্তব্যের পত্রপাঠ প্রতিবাদ জানায় ইসলামাবাদ। এর পর জুলাইয়ে রাশিয়ার উফায় বৈঠকে বসেন মোদী-শরিফ। স্বাক্ষর হয় সমঝোতাপত্র। অথচ অগস্টেই ফের হুরিয়তকে ঘিরে ভেস্তে যায় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের বৈঠক। এর পর চলতি বছরের নভেম্বরে আসে প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলন। সেখানেই একান্তে প্রায় কানে-কানে কথা বলতে দেখা যায় মোদী-শরিফকে। আস্থার নতুন ইনিংস তখন থেকেই চলছে।

মোদী-শরিফ বৈঠককে স্বাগত জানিয়ে মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক বলেছে, ‘‘ভারত-পাক সুসম্পর্ক গোটা এলাকার মঙ্গল করবে।’’ ঘরের মাঠে অবশ্য কটাক্ষের মুখে পড়েছেন মোদী। কংগ্রেসের অভিযোগ, এ ভাবে পাক-নীতিকে লঘু করে ফেলছেন মোদী। অনেকের আবার প্রশ্ন, পাক সরকারের উপরে সেনাবাহিনীই যখন ছড়ি ঘুরিয়ে চলে, তখন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সখ্য বাড়িয়ে কী?

এই প্রসঙ্গে বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, বারবার আলোচনা শুরু হয়েও ভেস্তে যাওয়ার পর পাক প্রশ্নে এ বার যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে কেন্দ্র। আর তাই শুধু পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নন, সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গেও সমান্তরাল আলোচনা প্রক্রিয়া চালাচ্ছে দিল্লি। পাকিস্তানের বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাসির খান জানুজা পাক সেনার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ছিলেন। পাক সেনাপ্রধান রাহিল শরিফের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ যথেষ্ট ভাল। ব্যাঙ্ককে এই জানুজার সঙ্গেই বৈঠক করেছিলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। এক কূটনীতিকের দাবি, ‘‘মোদী যে পাকিস্তানের সঙ্গে এত দ্রুত আলোচনার গতি বাড়িয়ে চলেছেন, তার পিছনে পাক সেনার প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পাক সেনা কিছুটা কৌশলগত স্থিতিস্থাপক (স্ট্র্যাটেজিক্যালি স্ট্রেচড) অবস্থান নিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।’’

বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘পাকিস্তান নিয়ে মোদীর উপরেও অন্দরের চাপ কম নেই। সেটা কখনও আসে সঙ্ঘের দিক থেকে। কখনও বেঁকে বসে কোনও জোট শরিক। কিন্তু আজকের সফর এতটাই আকস্মিক যে, তেমন কোনও চাপ মাথায় নিয়ে লাহৌরে নামতে হয়নি মোদীকে।’’ কেউ কেউ মনে করছেন, এই কৌশলী সফরে আরও একটি বার্তা দিতে চাইলেন মোদী। মাত্র ক’দিন আগে অসহিষ্ণুতার অভিযোগে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে তাঁর সরকারকে। এমন সময়ে পাক প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে খানা খেয়ে সেই অভিযোগ খণ্ডনের প্রয়াসও চালালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ‘দোস্তি’র রং তাই বহুমাত্রিক!

nawaz sharif lahore peace talk Narendra modi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy