আমি নিজে জড়িয়ে আছি কল্লোল-এর পুজোর সঙ্গে, খানিকটা পারিবারিক সূত্রেই বলা যায়। আর কল্লোল হল উত্তর আমেরিকার চার-পাঁচটা বড় পুজোর একটি, তিন দিনের পুজোয় চার-পাঁচ হাজার মানুষের ভিড় হয় এখানে। কল্লোলের পুজো তো আমার ঘরের পুজো, তা ছাড়াও নিউ জার্সির অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পুজো যেমন আনন্দ মন্দির, ভারত সেবাশ্রম, উৎসব, চেরি হিল, আটলান্টিক সিটি, ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার, গার্ডেন স্টেট পুজো কমিটি ইত্যাদি ইত্যাদি। এক নিউ জার্সিতেই এখন পুজো হয় খান বারো।
প্রস্তুতির গল্পটা অবশ্য কমবেশি একই রকম। কলকাতার বারোয়ারি পুজোয় যেমন সিংহভাগ জুড়ে থাকে মণ্ডপের পরিকল্পনা, মণ্ডপ নারকোলের খোল দিয়ে হবে না কি চায়ের ভাঁড়, বরাত কাকে দেওয়া হবে, সুশান্ত পাল না কি সনাতন দিন্দা— এখানে সে বালাই নেই, কল্লোলের পুজো যেমন হয় ইউক্রেনিয়ান চার্চে, সর্বধর্ম সমাহারের বিজ্ঞাপন একেবারে, কোনও পুজো হয় স্কুল হল-এ বা কোনওটা কোনও পারফর্মিং আর্ট সেন্টারে। ভারত সেবাশ্রম বা আনন্দ মন্দিরের পুজো অবশ্য হয় তাদেরই নিজস্ব মন্দির চত্বরে, একেবারে কলকাতার পুজোর সঙ্গে একই দিনে।
আরও পড়ুন: মাংস খাচ্ছেন গণেশ! অসি-বিজ্ঞাপনে কড়া নিন্দা নয়াদিল্লির
এখানে ব্যস্ততার পুরোভাগে থাকে জলসা, মূলত কলকাতার শিল্পীদের নির্বাচন ও উড়িয়ে আনার প্রস্তুতি। রূপঙ্কর না কি রাঘব, না না, ওরা তো বহু বার গেয়ে গেছে। অনুপম? যাঃ, অমুক পুজো অলরেডি বুক করে দিয়েছে তো! সিসি কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিল! ইমনের তো বাজার গরম, অ্যাওয়ার্ডটা টাটকা থাকতে থাকতেই এনে ফেলা যাক, সারেগামা-র জীমুত কিন্তু হেব্বি গাইছে, আর এখনও অত পায়াভারি হয়নি, ডাকবে না কি! নানা মুনির নানা মত-মতান্তর-মনান্তর-বাকবিতন্ডা চলতেই থাকে বছরভর। কোন পুজো কাকে আনছে তার উপরেই তো নির্ভর করে রেজিস্ট্রেশন। আর লোকাল প্রোগ্রাম সিলেকশন, বোঝাই যায়, কলকাতা হোক বা ক্যালিফোর্নিয়া, চাঁদে গেলেও বাঙালি বাঙালিই। অমুকে কেন নৃত্যনাট্য করাচ্ছে, তমুককে কেন সোলো দেওয়া হল, ও তো গত বছরেই বাচ্চাদের প্রোগ্রাম করিয়েছিল, আবার এবছর! নিশ্চয়ই কালচারাল সেক্রেটারির সঙ্গে আঁতাত আছে। পাশাপাশি, শ্রীমতী ক শ্রীমতী খ-এর সঙ্গে এক স্টেজে নাচ করবে না, গ আবার ঘ-এর সঙ্গে এক মঞ্চে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ডায়লগ বলবে না, বোর্ড অব ট্রাস্টির মেম্বার কেন অমুক আর্টিস্টকে কনফার্ম করে ফেলল কালচারাল কমিটির অজান্তে— প্রায় মানহানির মামলা ঠুকে দেওয়ার মতোই ঘোরতর ব্যাপার! এই সব হাস্যকর চাপানউতোর চলতেই থাকবে বছর বছর, ওই যে বললাম, আমেরিকা কেন, চাঁদে গেলেও বাঙালি এই বাঙালিয়ানা ছাড়তে পারবে না, গান হবে নাচ হবে জলসা হবে, পুজো হবে, আর বাঙালি একটু খুনসুটি করবে না, একটু ল্যাজা মুড়ো ধরে টানবে না, একটু পলিটিক্স করবে না, তা কি হয়! আর সত্যি বলতে কি ঝোলে ঝালে অম্বলে এই ফোড়নটুকু না থাকলেও যেন উৎসবের ফ্লেভারটা আসে না।