এই বাঙ্কারেই লুকিয়ে সিয়োনা ও তাঁর বন্ধুরা। নিজস্ব চিত্র।
এক সপ্তাহ ধরে আমরা বাঙ্কারের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছি। বৃহস্পতিবার সন্ধে সাতটা নাগাদ হস্টেলের পাশেই কারখানার উপরে এসে বোমা পড়ল। কী ভীষণ শব্দ! বিদ্যুৎ সরবরাহও চলে গিয়েছে। জলের লাইনও বিচ্ছিন্ন। কী হবে জানি না। অন্ধকার বাঙ্কারে বসে আছি। দয়া করে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে আমাদের উদ্ধার করুন। দেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। এটুকুই শুধু আর্তি।
তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা জেলার করাইকুরিতে আমার বাড়ি। সেখান থেকে বছর কয়েক আগে সুমি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ডাক্তারি পড়তে এসেছিলাম। এখন দ্বিতীয় বর্ষে রয়েছি। কখনও ভাবিনি, এই যুদ্ধের মধ্যে পড়ে যাব। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে প্রায় ৫০০ ভারতীয় ছাত্রছাত্রী আটকে পড়েছে। এর মধ্যে আমাদের হস্টেলে রয়েছেন কমপক্ষে ২০০ জন। সকলেরই দিন কাটছে বাঙ্কারে।
ইউক্রেনের উত্তর-পূর্ব দিকের এই শহর রাশিয়া সীমান্তের কাছেই। ইউক্রেনের উত্তর-পূর্ব এবং পূর্ব দিক থেকেই আক্রমণ শুরু করেছে রাশিয়া। তাই ইউক্রেনের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা দেশে ফেরার চেষ্টা করছে। পশ্চিম সীমান্তের দিকে যেতে পারলে সীমান্ত পেরিয়ে পোল্যান্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি হয়ে দেশে ফিরতে পারি। কিন্তু সুমি থেকে পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দেশ জুড়ে যুদ্ধ চলেছে। তার মধ্য দিয়ে এই পরিস্থিতিতে হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে পশ্চিম সীমান্তে পৌঁছনো আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এই দেশ থেকে বেরোতে হলে রাশিয়ার দিক থেকে বেরোনো সহজ। এ দিন বিকেল চারটের সময়ে আমাদের যিনি কো-অর্ডিনেটর, তিনি খবর দিয়েছিলেন, রাশিয়া সীমান্তের ওপারে সুদজার কাছে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন থেকে আমাদের রাশিয়ায় ঢোকার অনুমতি দেওয়া হবে কি না এখনও জানি না। সুমির রেল পরিষেবা রুশ বাহিনী সম্পুর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। রাশিয়া সীমান্ত পর্যন্ত যাওয়ার জন্য এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যানবাহন খুঁজে পাওয়া এখন অসম্ভব। বিপজ্জনকও বটে।
এই অবস্থায় আমরা চরম আতঙ্কের মধ্যে হস্টেলের বাঙ্কারে দিন কাটাচ্ছি। এখানে সব হস্টেলেই বাঙ্কার থাকে। জানি না কেন এগুলো বানানো হয়েছিল। ডাক্তারি পড়তে এসে আজ প্রাণ বাঁচাতে এখন এই বাঙ্কারেই দিন কাটছে। যে দিন রাশিয়া আক্রমণ শুরু করল, সে দিন ঠিক তার আগেই ইউনিভার্সিটি থেকে আমরা ই-মেল পাই। তাতে বলা হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা যেন দেশে ফিরে যাই। আমি সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফেরার জন্য ২৬ ফেব্রুয়ারির প্লেনের টিকিট কাটি। কিন্তু এর পর পরিস্থিতি এমন খারাপ হল, আমি আর ২৬ তারিখ এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌছতে পারলাম না। আশ্রয় নিতে হল অন্যান্য সহপাঠীদের সঙ্গে এই বাঙ্কারে।
প্রতিনিয়ত কানে আসছে বোমের আওয়াজ। এই পরিস্থিতিতে বেরিয়ে কোথায় যাব জানি না। খাবার অথবা অন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে যাওয়ারও সাহস হচ্ছে না। কো-অর্ডিনেটর আমাদের কিছু সবজি জোগাড় করে এনে দিচ্ছেন। তাই খাওয়া হচ্ছে। যতটা সম্ভব কম খেয়ে থাকছি। জানি না আগামিকাল হয়তো এই সবজিও পাব না।
বাড়িতে আমার বাবা, মা, ছোট ভাই আর ঠাকুমা, ঠাকুরদা রয়েছে। আমি ওদের কাছে ফিরতে চাই। এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের বের করে নেওয়া হোক।
(লেখিকা ডাক্তারি ছাত্রী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy