Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

চিন সাগর নিয়ে প্যাঁচে বেজিং, সতর্ক দিল্লি

সাগর দখলের যুদ্ধে যথেষ্ট বেকায়দায় পড়ে গেল বেজিং। দক্ষিণ চিন সাগরের জলসীমা ও তার সম্পদের উপরে বেজিংয়ের কোনও ঐতিহাসিক অধিকার নেই বলে জানিয়ে দিল দ্য হেগ-এ রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। এই পরিস্থিতিকে ভারত পরে কূটনৈতিক ভাবে কাজে লাগাতে পারবে বলেই আশা সাউথ ব্লকের। তাই আপাতত সতর্ক হয়ে এগোতে চাইছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।

এই সব কৃত্রিম ভূখণ্ড আসলে দ্বীপই নয়, জানিয়ে দিল আন্তর্জাতিক আদালত। —ফাইল চিত্র।

এই সব কৃত্রিম ভূখণ্ড আসলে দ্বীপই নয়, জানিয়ে দিল আন্তর্জাতিক আদালত। —ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৬ ১৬:৫৭
Share: Save:

সাগর দখলের যুদ্ধে যথেষ্ট বেকায়দায় পড়ে গেল বেজিং। দক্ষিণ চিন সাগরের জলসীমা ও তার সম্পদের উপরে বেজিংয়ের কোনও ঐতিহাসিক অধিকার নেই বলে জানিয়ে দিল দ্য হেগ-এ রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। এই পরিস্থিতিকে ভারত পরে কূটনৈতিক ভাবে কাজে লাগাতে পারবে বলেই আশা সাউথ ব্লকের। তাই আপাতত সতর্ক হয়ে এগোতে চাইছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।

দীর্ঘ দিন ধরেই দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিংয়ের কার্যকলাপ নিয়ে ক্ষুব্ধ আমেরিকা, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনামের মতো দেশ। ওই এলাকা নিজেদের দখলে রাখতে বেশ কয়েকটি কৃত্রিম দ্বীপও তৈরি করেছে চিন। আন্তর্জাতিক জলপথ হিসেবে স্বীকৃত এই এলাকায় চিনের খবরদারিতে ভারতের স্বার্থেও আঘাত লেগেছে। ফলে আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে দক্ষিণ চিন সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল ভারত।

আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে চিনের বিরুদ্ধে মামলা করে ফিলিপিন্স। এ দিন আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, চিনের ঐতিহাসিক অধিকারের কোনও আইনি ভিত্তি নেই। বরং কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করতে গিয়ে প্রবাল প্রাচীরের ক্ষতি করেছে চিন। বেশ কিছু বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীও যথেচ্ছ ভাবে ধরেছেন চিনা ধীবররা।

প্রত্যাশিত ভাবেই রায় নিয়ে উচ্ছ্বসিত ফিলিপিন্স ও আমেরিকা। কিন্তু বেজিংকে এই রায় মানতে বাধ্য করানোর মতো কোনও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নেই বলে মেনে নিচ্ছেন কূটনীতিকরা। চিন মামলায় অংশ নেয়নি। আজ তারা জানিয়ে দিয়েছে, এই রায় বেজিং মানবে না। সে দেশের যুদ্ধজাহাজ দক্ষিণ চিন সাগরে সক্রিয় থাকবে।

সাউথ ব্লক সূত্রে খবর, প্রকাশ্যে এই রায়কে চিন উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই রায়ে মুখ পুড়েছে চিনা সরকারের। এমন ঘটনা হতে পারে বুঝেই চিন ভারতকে একটি গোপন বার্তা পাঠিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ভারতের স্বার্থ জড়িত রয়েছে এমন কিছু বিষয়ের ফয়সালা এখন চিনের মত ছাড়া সম্ভব নয়। দক্ষিণ চিন সাগর বিতর্কে ভারত আমেরিকার সঙ্গ ছাড়লে চিন সেই বিষয়গুলি বিবেচনা করে দেখবে বলেও ওই বার্তায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি পারমাণবিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে (এনএসজি) ভারতের ঢোকার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল চিন। সাউথ ব্লক সূত্রের মতে, দক্ষিণ চিন সাগরের বদলে ওই বিষয়টি নিয়েই দর কষাকষি করতে চেয়েছে বেজিং।

তাই চিন সাগর সংক্রান্ত রায় নিয়ে ‘ধীরে চলো’ কৌশল নিয়েছে ভারতও। বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, ভারত রায়টি ‘খতিয়ে দেখছে’। মন্ত্রক সূত্রে খবর, এনএসজি-র সদস্যপদের বিষয়টির বদলে এ নিয়ে বেজিংয়ের সঙ্গে দর কষাকষি করতে চায় দিল্লিও। সে জন্যই আপাতত কোনও পক্ষে যোগ দিতে রাজি নয় তারা। আগে বেজিংয়ের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করা হবে।

এখন কী পরিস্থিতি দক্ষিণ চিন সাগরে?

সঙ্ঘাত প্রত্যাশিতই ছিল। ফিলিফিন্স আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হওয়ার পর থেকেই চিন যে ভাবে বার বার বলছিল, আদালতের রায়ের পরোয়া বেজিং করবে না, তাতে রায় ঘোষণার পর দক্ষিণ চিন সাগরের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হবে বলে ওয়াকিবহাল মহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল আগেই। হলও তাই। ১২ জুলাই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করবে, তা আগেই জানানো হয়েছিল। তাই রায় ঘোষণার কয়েক দিন আগে থেকেই দক্ষিণ চিন সাগরের বিভিন্ন বিতর্কিত এলাকায় চিনা নৌসেনা মহড়া দিতে শুরু করে। গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার এবং ফ্রিগেট পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওই সমুদ্রের সেই সব এলাকায়, যে গুলিকে ফিলিপিন্স নিজেদের জলসীমা বলে দাবি করে। ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে মহড়া দিতে শুরু করে চিন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শক্তি প্রদর্শন করে ফিলিপিন্সকে চাপে রাখতেই চিনের এই কৌশল। কিন্তু আমেরিকা-সহ গোটা ন্যাটো বাহিনী ফিলিপিন্সের পাশে থাকায়, ম্যানিলাও নতি স্বীকার করছে না।

সঙ্ঘাত কী নিয়ে?

সাধারণত যে কোনও দেশের উপকূল রেখা থেকে সমুদ্রের গভীরে ২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকাকে সেই দেশের নিজস্ব জলসীমা হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু, বেজিং‌ যে ভাবে গোটা দক্ষিণ চিন সাগরের ৯০ শতাংশকেই নিজেদের এলাকা বলে দাবি করছে, তাতে আন্তর্জাতিক নিয়ম তো লঙ্ঘিত হচ্ছেই। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশের সার্বভৌমত্বও লঙ্ঘিত হচ্ছে। চিন সাগরকে ঘিরে যতগুলি দেশ রয়েছে, তার অধিকাংশের সঙ্গেই জলসীমা নিয়ে চিনের বিরোধ রয়েছে। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান, জাপান— সবক’টি দেশের অধিকারই খর্ব হচ্ছে চিনা আগ্রাসনে। তাদের জাপান সরাসরি সঙ্ঘাতের পথ বেছে নিয়েছে। আর ফিলিপিন্স আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল। হেগ এর ট্রাইব্যুনাল আজ ফিলিপিন্সের পক্ষে রায় দেওয়ায় অন্য দেশগুলিও স্বাভাবিক ভাবেই উল্লসিত।

কোন কোন দেশের সঙ্গে সঙ্ঘাত চিনের?

দক্ষিণ চিন সাগরের ৯০ শতাংশ এলাকা ঐতিহাসিক ভাবে চিনের। দাবি করছে বেজিং। এই দাবি যে ঠিক, তা প্রমাণ করতে সমুদ্রের বিভিন্ন এলাকায় তারা কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করা শুরু করে। বেশ কিছু প্রবাল প্রাচীর এবং সমুদ্রের মধ্যে জেগে থাকা কিছু পাথুরে অংশে বালি ফেলে ফেলে তা ছোট ছোট দ্বীপ তৈরি করে চিন। সেই সব দ্বীপে সামরিক পরিকাঠামো এবং রানওয়ে গড়ে তোলে। বসানো হয় মিসাইল লঞ্চারও। কিন্তু যে সব এলাকায় গিয়ে এই সব কৃত্রিম দ্বীপ চিন গড়ে তুলেছে, তার কোনওটিই চিনা উপকূল রেখার ২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে পড়ে না। বহু বহু দূরে অবস্থিত সেগুলি। প্যারাসেল আইল্যান্ডস নামে কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ চিন তৈরি করেছে, তা নিয়ে চিনের সঙ্গে ভিয়েতনামের বিরোধ চলছে। ফিলিপিন্সের উপকূলের গা ঘেঁষে তৈরি করা স্প্র্যাটলি আইল্যান্ডস নিয়ে চিনের বিরোধ চলছে ফিলিপিন্সের সঙ্গে। সেই মামলার রায়ই আজ ঘোষিত হল। এ ছাড়া স্কারবোরো শোয়াল নিয়ে বিরোধ চলছে তাইওয়ানের সঙ্গে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE