সে-ই প্রথম। শুরুর শুরু। তার পর একশোটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। তবে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটা এখনও থামেনি। বরং বেড়েই চলেছে উত্তরোত্তর। ৩১ জানুয়ারি, ১৯১৫। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে পৃথিবী প্রথম বার জানতে পারল ‘রাসায়নিক যুদ্ধ’ কাকে বলে। তার পর বদলে গিয়েছে সময়। বিজ্ঞানও এগিয়েছে তার স্বাভাবিক ছন্দে। আর তত হিংস্র হয়ে উঠেছে সেই যুদ্ধ।
পোল্যান্ডের বলিমউ গ্রাম। একটি গির্জার চুড়োয় উঠে নীচের এলাকাটি শ্যেন দৃষ্টিতে দেখছেন জার্মান সেনাবাহিনীর জেনারেল ম্যাক্স হফ্ম্যান। তাঁর নির্দেশেই তখন ১৮ হাজার ‘গ্যাস বোমা’ ছোড়া হল রাশিয়ার সেনাদের উপর। সেই বোমাগুলির মধ্যে যে রাসায়নিকটি ছিল তার নাম ‘জাইলাইল ব্রোমাইড’। কাঁদানে গ্যাস হিসেবে আগে তা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু আশানুরূপ ফল পেল না জার্মান সেনারা।
কেন?
প্রচণ্ড শীতের ফলেই বিষাক্ত গ্যাসটি বাষ্পে পরিণত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। তাই সেই ভাবে ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি তখন।
তবে, গোড়াপত্তন হিসেবে সেই প্রয়াসটি ছিল যথেষ্ট। ফল ভাল না হওয়ায় আবার শুরু হল গবেষণা। আর এ বার তা হতাশ করল না জার্মানদের। ইয়েপ্রিসের যুদ্ধে ফ্রান্সের হাজারো হাজারো সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে ক্লোরিন গ্যাসের ধোঁয়ায় জ্ঞান হারালেন। আসলে, এই ‘অজানা অস্ত্র’-টির সম্পর্কে কারও কোনও তেমন জ্ঞান ছিল না। তাই কেউই সাবধান হতে পারেনি। আর তাতেই যত বিপত্তি।
নতুন এই অস্ত্রটিতে শুধু যে হাজারো মানুষের মৃত্যু হল তা নয়, ভেঙে পড়ল যুদ্ধের চিরাচরিত নিয়মও। বদলে গেল যুদ্ধের সংজ্ঞা। এক ব্রিটিশ কম্যান্ডার স্যার জন ফ্রেঞ্চ বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রেও যে নিয়মনীতি থাকে, বর্বরোচিত এই অস্ত্রের ব্যবহারে ভেঙে পড়ল তা-ও।
কিন্তু একা জার্মানি নয়। আসলে বীজটা জার্মানরা পুঁতলেও এর পর থেকে প্রত্যেকেই একে অপরের বিরুদ্ধে এই নতুন অস্ত্রটি শানাতে লাগল। এর মাস চারেক পরে লু-এর যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রিটেন গ্যাস দিয়ে পাল্টা আক্রমণ হানল জার্মানদের উপর।
তবে এর সাফাই গেয়েছেন স্যার জন। তিনি বলেছেন, “আমাদের উপর শত্রুপক্ষ বার বার এই দমবন্ধকর গ্যাসটি ব্যবহার করছিল। তাই আমরাও তখন সেই এক পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হই।” যুক্তি আর পাল্টা যুক্তি যা-ই থাকুক। ফলটা সেই এক-ই। হাজার হাজার মানুষের শবদেহ।
জার্মান কম্যান্ডার জেন কার্ল ভন এনিম বলেছেন, “... সভ্যতা যত এগিয়েছে, ততই হিংস্র হয়ে উঠেছে মানুষ।” তিনি রাসায়নিক ব্যবহারকে ‘কাপুরুষদের অস্ত্র’ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন।
আসলে এই গ্যাস অস্ত্রটি মানসিক ভাবেও নাড়িয়ে দিত যে কাউকে। চোখে দেখতে না পেলেও ভূতকে ভয় পায় অনেকে। ঠিক তেমন ভাবেই গ্যাস অস্ত্রটির সচরাচর দেখা মেলে না। কিন্তু তাড়িয়ে বেড়ায় সকলকে।
স্যার জন এটিকে ‘ভৌতিক বিজ্ঞান’ বলেছেন। যার আঘাতের চিহ্ণ শরীরে মেলে না, অথচ ফল ভোগ করতে হয় মানুষটিকে। যেমন, ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেফটেন্যান্ট জি এল গ্র্যান্টকে হাজারো সেনাকে চিকিৎসা করতে হয়েছিল। এঁরা সকলেই নাকি গ্যাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। তবে, তাদের শরীরে তেমন কোনও চিহ্ণ ছিল না। ঠিক একই রকম হয়েছিল ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতেও। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে লেখা কবি উলফ্রেড ওয়েনের চিঠিতেও বার বার পাওয়া গিয়েছে ক্লোরিন আক্রমণের উল্লেখ।
১৯১৫, ১৯১৮... বছর ঘুরে গিয়েছে। সময় বদলে গিয়েছে। আর বদলে গিয়েছে আক্রমণের ধরন। তবে, আক্রমণ এখনও চলছে। গাজা হোক বা সিরিয়া, দেশ-কালের বেড়া ভেঙে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মৃত্যুমিছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy