Advertisement
E-Paper

আতঙ্কে শুরু, স্বস্তিতে শেষ, গুলশন হামলাই বাংলাদেশের টার্নিং পয়েন্ট

হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হানার আগে আর পরে একেবারে যেন ভিন্ন দুই বাংলাদেশ। ব্লগার রাজীব হায়দারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার মধ্যে দিয়ে যে ভয়ের সংস্কৃতি বাংলাদেশ জুড়ে জাঁকিয়ে বসেছিল, কয়েক দফা জঙ্গি ডেরায় হানা আর জঙ্গিদের বেশ কয়েকজন চাঁইকে খতমের মধ্যে দিয়ে সেই ভয়ের কালো মেঘ এখন অনেকটাই ফিকে।

অঞ্জন রায়

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৪:৫৬
আতঙ্ক থেকে স্বস্তি...নতুন বাংলাদেশ

আতঙ্ক থেকে স্বস্তি...নতুন বাংলাদেশ

হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হানার আগে আর পরে একেবারে যেন ভিন্ন দুই বাংলাদেশ। ব্লগার রাজীব হায়দারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার মধ্যে দিয়ে যে ভয়ের সংস্কৃতি বাংলাদেশ জুড়ে জাঁকিয়ে বসেছিল, কয়েক দফা জঙ্গি ডেরায় হানা আর জঙ্গিদের বেশ কয়েকজন চাঁইকে খতমের মধ্যে দিয়ে সেই ভয়ের কালো মেঘ এখন অনেকটাই ফিকে। অনেকটা স্বস্তির হয়ে উঠেছে মানুষের দিনযাপন। এমনকী জঙ্গীদের হুমকিতে যাঁরা এত দিন শঙ্কিত ছিলেন, তাঁরাও সেই দম আটকানো দিনগুলোতে এখন আর নাই।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ আন্দোলন শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে, তাঁর বাড়ির সামনেই চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক রাজীব হায়দারকে। এই হত্যার পরই দেশে উস্কে দেওয়া হয় আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক। শাহবাগ আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীরা নাস্তিক- এটা প্রমাণে মাঠে নামল হেফাজতে ইসলাম নামের একটা সংগঠন। ২০১৩-র ৫ এপ্রিল প্রথম সমাবেশের পরে তারা ৫ মে ঢাকাতে দ্বিতীয় সমাবেশ করেছিল মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে। তারা ১৩ দফা দাবি ঘোষণা করে সেই সময়ে। তারা স্থায়ী অবস্থান মঞ্চ করার চেষ্টা করেছিল শাপলা চত্ত্বরে। মাঝরাতের পরে র‌্যাব, পুলিশ আর বিজিপির মিলিত অভিযানে সেই অবস্থান তুলে দেওয়া হয়েছিল।

একের পর এক ব্লগার খুনে প্রতিবাদ

৫ মে ২০১৩ ঢাকা শহরের চেহারা পাল্টে গিয়েছিল। এক দিনে এত নাশকতার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে আর নাই। সে দিন গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, বা কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে আগুনই শুধু দেওয়া হয়নি- জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারমের পাশের ধর্ম গ্রন্থের দোকানে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। পল্টন এলাকা-সহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় কেটে ফেলা হয়েছিল অজস্র গাছ। সেই কাটা গাছ দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল রাস্তায়।

সারা দেশেই এর আগে আরেক দফা অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল জামাত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদির যুদ্ধপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর। তখন বগুড়ার গ্রামে রটিয়ে দেওয়া হল- এই যুদ্ধপরাধীকে নাকি আকাশের চাঁদে দেখা গেছে। সেই পরিকল্পিত ভাবে রটানো গুজবের জেরে উন্মত্ততায়, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় বেশ কয়েক জন।

২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর গভীর রাতে ঢাকার হোসেনি দালানে তাজিয়া মিছিলে হামলা চালায় জঙ্গিরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা এটি। শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলায় নিহত হয় এক কিশোর, আহত হন অর্ধশতাধিক মানুষ। পরের মাসে বগুড়ায় শিয়া মসজিদে ঢুকে গুলি চালানো হলে তার মুয়াজ্জিন নিহত হন। ডিসেম্বরে রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত ও ১০ জন আহত হন। একই মাসে দিনাজপুরে রাসমেলার যাত্রা প্যান্ডেলে বোমা বিস্ফোরণে ১০ জনেরও বেশি আহত হয়েছিলেন। সব হামলাতেই আইএস ও জেএমবি উভয়ই দায়িত্ব স্বীকার করে।

২০১৬ সালের শুরু থেকে একে একে যাঁরা জঙ্গিবাদের শিকার হন, তাঁরা হলেন- পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জে হিন্দু পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর রায়, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার নাজিমুদ্দিন সামাদ, ঝিনাইদহে শিয়া ধর্ম প্রচারক আব্দুল রাজ্জাক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী, সমকামী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কাগজ ‘রূপবান’ পত্রিকার সম্পাদক জুলহাস মান্নান, নাট্য ও সমকামীদের অধিকার আন্দোলনের কর্মী মাহবুব তন্ময়, নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার, রাজশাহীর তানোর উপজেলার পির মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বান্দরবানের চাক পাড়ার বৌদ্ধ ভিক্ষু মংশৈ উ চাক, গোবিন্দগঞ্জের জুতা ব্যবসায়ী দেবেশ চন্দ্র প্রামাণিক, নাটোরে খ্রিস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজ, ঝিনাইদহে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি, পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুরে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে, ঝিনাইদহের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস ও বান্দরবানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মংশৈনু মারমা। এ সব হত্যাকাণ্ডের কয়েকটিতে আনসার-আল-ইসলামের নাম এলেও অধিকাংশ হত্যার জন্য আইএস দায়িত্ব স্বীকার করে। সেই দায় প্রচার করে রিটা কর্জের আলোচিত ওয়েব সাইট, ‘সাইট ইন্টেলিজেন্ট’।

চোরাগোপ্তা, আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার ইতিহাস থাকলেও, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের স্টাইলে পণবন্দি করার ঘটনা গুলশনের আগে বাংলাদেশে ঘটেনি। এটা বাংলাদেশের বুকে সবচেয়ে বড় জঙ্গি নাশকতাও বটে। হোলি আর্টিজান বেকারির সেই হামলায় ১৭ বিদেশি (ন’জন ইতালীয়, সাত জাপানি, এক ভারতীয় নাগরিক)-সহ ২০ জন মারা যান। পাঁচ জঙ্গি ও এক সন্দেহভাজন এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তারও মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে ২৮ জন। জীবিত উদ্ধার করা হয় ১৩ জনকে।

হোলি আর্টিজান বেকারির ঘটনা কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র বদল করে দিল। সন্ত্রাসবাদীদের আর এক বিন্দু বরদাস্ত না করার কঠোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও এর এক সপ্তাহের মধ্যে ইদের দিন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইদের জামাত শোলাকিয়ার থেকে এক কিলোমিটার দূরে পুলিশের ওপর হামলা করে জঙ্গিরা। নিহত হন এক পুলিশকর্মী-সহ দুজন। তবে জঙ্গিদের নিশানা ছিল আরও অনেক বড়। সফল ভাবে সেই বড় নাশকতার ছক রুখেছিল পুলিশ। বলা যায় তার পরই উল্টোপিঠ দেখতে শুরু করে জঙ্গিরা।

পুলিশ, র‌্যাব-সহ আইন শৃংখলা বাহিনীর একটার পর একটা অভিযানে তছনছ হতে শুরু করে দেশের জঙ্গিদের আস্তানাগুলো। খতম হতে থাকে চাঁইরা। ঢাকার কল্যাণপুরে ২৬ জুলাই ভোর ৫ টা ৫১ মিনিট থেকে জঙ্গিদের আস্তানায় এক ঘণ্টা ধরে পুলিশ ‘অপারেশন স্টর্ম ২৬’ নামের অভিযান চালায়। এই অভিযানে খতম হয় ৮ জঙ্গি। আহত হন কয়েক জন পুলিশ।

২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকপাড়াতে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে অন্তত ৩ জন জঙ্গি নিহত হয়। তাদের মধ্যে ছিল ঢাকার গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরী। তামিম-ই নব্য জেএমবির প্রধানতম মাস্টামাইন্ড ছিল।

গুলশন জঙ্গি হানায় পুলিশ, র‌্যাবের নজরদারি

২ সেপ্টম্বরে অভিযান চলে ঢাকার রূপনগরে। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার অভিযানের সময় মেজর জাহিদ সেখান থেকে পালিয়ে যায়। পরে সে রুপনগরের ৩৩ নম্বর রোডের ৩৪ নম্বর বাড়ির ষষ্ঠ তলায় আত্মগোপণ করে। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ অভিযান চালায়। অভিযানে রুপনগর থানার ওসি শহিদ আলম, পরিদর্শক শাহীন ফকির ও এসআই মমিনুল রহমান আহত হয়েছিলেন। জাহিদ নিহত হয়।

১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬। আজিমপুরের ২০৯/৫ পিলখানা রোডের একটি ছ’তলা আবাসিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় অভিযান চালায় বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। ওই বাড়ি থেকে এক জঙ্গির মৃতদেহ মেলে। আহত তিন নারী জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় নিহত জঙ্গি করিমের কিশোর ছেলেকে।

হোলি আর্টিজান ঘটনার স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন

৮ অক্টোবর গাজিপুরের দুটি এবং টাঙ্গাইল ও আশুলিয়ায় একটি করে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চলে। ১২ জঙ্গি নিহত হয়। এর মধ্যে গাজিপুরের আস্তানায় অভিযানেই নিহত হয় ৭ জন। পুলিশ এই অভিযানের নাম দেয় ‘অপারেশন শরতের তুফান’। র‌্যাবের চালানো অভিযানে গাজিপুরে অন্য এক আস্তানায় রাশেদুল ও তৌহিদুল ইসলাম নামে দুই জঙ্গি মারা যায়। টাঙ্গাইলের জঙ্গি আস্তানায় চালানো অভিযানে সাগর ও আতিক নামে দুই জঙ্গি নিহত হয় সেই দিনেই। গাজিপুরের দুই আস্তানার মধ্যে দূরত্ব ছিল মাত্র আধ কিলোমিটার। সে দিনই ঢাকার পাশের আশুলিয়ার বাইপাইলের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের আহত অবস্থায় আটক করা হয় আব্দুর রহমান ওরফে আইনুল ওরফে নাজমুল সাভারের এনাম। পরে সে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়। র‌্যাব জানায়, আব্দুর রহমান নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি-র মূল অর্থদাতা। অভিযানের সময় তার দুই স্ত্রী ও দুই কন্যাকেও আটক করা হয়। এ সময় আব্দুর রহমানের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা ও প্রচুর অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।

২৪ ডিসেম্বর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে আশকোনা এলাকাতে একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে জঙ্গিবিরোধী 'রিপেল ২৪' নামের অভিযানে জঙ্গি সুমনের স্ত্রী ও জঙ্গি তানভীর কাদেরীর কিশোর সন্তান আবিদ কাদের নিহত হয়। ওই বাড়িতে ঘাঁটি গাড়া জঙ্গি সম্প্রতি নিহত জঙ্গি নেতা জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী এবং পলাতক জঙ্গি মুছা ওরফে ইমতিয়াজের স্ত্রী দুই শিশু-সহ আত্মসমর্পণ করেছে। অভিযানে চার বছরের এক শিশু ও পুলিশের এক সদস্য আহত। রাত ১১টা থেকে শুরু হওয়া এ অভিযান পর দিন দুপুরে শেষ করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। এখানেই নারী জঙ্গি শারিকা (জঙ্গি সুমনের স্ত্রী) সুইসাইডাল ভেস্ট বিস্ফোরণে মারা যায়।

হোলি আর্টিজান বেকারি আর শোলাকিয়া হামলার আগে পরের পরিস্থিতিতে এ ভাবেই ফারাক তৈরি হয়েছে বিস্তর। ১ আর ৭ জুলাইয়ের আগে জঙ্গিরা হয়ে উঠেছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। আর ৭ জুলাইয়ের পরের স্রোত একদম উল্টোমুখি। এখন বাংলাদেশে জঙ্গিরাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের চাপাতির দাপট কার্যত শেষ। তবে পালিয়েও রক্ষা মিলছে না। তাদের প্রতিটি ডেরায় খোঁজ পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের পুলিশ। জারি আছে একটার পর একটা অভিযান। যে কারণেই আর মাথা তুলতে পারেনি জঙ্গিরা। সাধারণ নাগরিকদেরও কেটে যাচ্ছে ভয় আর শঙ্কা।

২০১৬-র দুই অর্ধ তাই দুই বাংলাদেশকে দেখল। প্রথমার্ধ আতঙ্কের। দ্বিতীয়ার্ধ আতঙ্ক থেকে মুক্তির।

Year Round Up Gulshan Dhaka 2016
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy