ঢাকার রাস্তায় মানুষের ঢল। নিজস্ব চিত্র
রুখে দাঁড়ানোর শপথ নিয়েই বাংলাদেশের মানুষ বরণ করে নিল নতুন বাংলা বছরটিকে।
ভোরে ছায়ানটের বর্ষবরণ দিয়ে শুরু। সকালে হাজার হাজার মানুষ হেঁটেছে চারুকলার সামনের মঙ্গল শোভাযাত্রায়। সমবেত সেই মানুষ আজ আবারও জানান দিয়ে দিয়েছে, সকল অন্ধকারের বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াই জারি আছে, থাকবে।
এই দেশের সাংস্কৃতিক কর্মীরা রবীন্দ্রনাথকে হাতিয়ার করে রুখে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানি শাসন আমলে। ১৯৬১তে পাকিস্তান সরকারের প্রচণ্ড রকমের বিরোধিতাকে আমল না দিয়ে ঢাকা-সহ সারা দেশে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসব পালিত হয়েছিল। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ছিল— ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি বাঙালি।’ অন্য সংস্কৃতির শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন বা লড়াইয়ে বাঙালিরা ধর্ম পরিচয় নয়— পদ্মা, মেঘনা, যমুনা পাড়ের সংস্কৃতির পরিচয়েই সমবেত হয়েছে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি, বাংলাদেশের মানুষকে বার বার অপশক্তি আক্রমণ করেছে। বাঙালি সংস্কৃতিকে তছনছ করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু, সেই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। প্রতিপক্ষের বুলেট বা ধর্মাশ্রয়ী বিষবাষ্পের চাইতে অনেক শক্তিশালী আমাদের ভাষার অস্ত্র, আমাদের রবীন্দ্রনাথ-নজরুল। সেই শক্তিতেই এ দেশের মানুষ সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করেই ও-সব আক্রমণ রুখে দিয়েছে।
গত বার আর এ বারের পয়লা বৈশাখের মধ্যে একটা বড় ঘটনা ঘটে গিয়েছে বাংলাদেশে।
এর আগে মুক্তমনা লেখক, পুরোহিত, পির, বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হানার ঘটনাটি ঘটে গত বছর পয়লা বৈশাখের মাত্র দু’মাস পরে। হলি আর্টিজান বেকারিতে সেই জঙ্গি হামলা চমকে দিয়েছিল গোটা দুনিয়াকে। পাশাপাশি মনে করিয়ে দিয়েছিল, এই হামলা রুখতে বাঙালিকে আবারও তার আবহমান সংস্কৃতিকেই হাতিয়ার করতে হবে।
সেটাই হয়েছিল। পয়লা বৈশাখ আমাদের যে শেকড়ের সন্ধান দিয়েছে, সেই শেকড়ই সে দিন এই জনপদের মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছিল— আমরা এত সহজে পরাজিত হব না। সে কারণেই হলি আর্টিজানের ঘটনার কয়েক দিন পরেই শোলাকিয়া ইদ্গার মাঠ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু।
এই দেশের যে সব অন্ধকার শক্তি, তারা বাঙালির ভাষা আর সংস্কৃতির এই হাতিয়ারকে খুব ভাল করেই চেনে। সে কারণেই কখনও শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো, কখনও মঙ্গল শোভাযাত্রা বা পয়লা বৈশাখ পালনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচারণা অব্যাহত থেকেছে। পাকিস্তানি শাসকদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ১৯৬৭ থেকে গত ৫০ বছর ধরে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। জঙ্গিরা বোমা মেরে মানুষ হত্যা করেও এই আয়োজন বানচালের চেষ্টা করেছে।
অবাক হতে হয়, রমনা বটমূলে বোমা হামলার পরের বছর সেখানে আগের বারের চেয়ে আরও কয়েক গুণ বেশি মানুষ সমবেত হয়েছে। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, দূর মফস্সলের মানুষও সেখানে জড় হয়েছেন। বছরের প্রথম দিনে সেই হত্যার স্মৃতিকে মনে রেখে লড়াই জারি রাখার শপথ নিয়েছেন অসংখ্য মানুষ।
বাংলাদেশ এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে পাড়ি দিচ্ছে। এক দিকে, বিশ্ব জুড়ে যে অন্ধত্বের আস্ফালন, সেই আঁচ এ দেশে পড়ছে। অন্য দিকে, যুদ্ধপরাধীদের বিচারকাজের বড় একটা অংশ শেষ হলেও সেই দর্শনে বিশ্বাসী মানুষগুলো এখনও রয়েছে। তাদের মরণ কামড়ের পাশাপাশি রাজনীতির মারপ্যাঁচ, ধর্মের ব্যবহার চলছেই। একাধিক আত্মঘাতী বিস্ফোরণ বুঝিয়ে দিয়েছে জঙ্গিবাদের শেকড় এখনও উপড়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। সে কারণেই লড়াইটা জারি রাখা খুবই জরুরি।
এই অন্ধকার রুখতে বাঙালির অস্তিত্বই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। কারণ, বাংলাদেশ যে প্রগতি আর অগ্রগতির দিকে চলেছে, সেটি-ই এই অন্ধকার-অপশক্তির পছন্দ নয়। সে কারণেই কখনও বিদ্বেষ ছড়িয়ে, কখনও বোমা মেরে তারা সেই গতি রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। শেকড় উপড়ে না নেওয়া পর্যন্ত তারা সেই চেষ্টা করতেই থাকবে। তাই শেষ না হওয়া পর্যন্ত থেমে যাওয়ার কোনও ফুরসত নেই।
অনেক শঙ্কা, বিষবাষ্পও এ বারের পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশের মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। আজ সারা দিনই রাজধানী ঢাকা-সহ সারা দেশের প্রতিটি পথই ছিল উৎসবে মাতোয়ারা মানুষের ভিড়ে পরিপূর্ণ। শিশু থেকে বৃদ্ধ— সবাই পথে নেমে এসেছিলেন। তাঁরা স্পর্শ করেছেন বাঙালির শেকড়। বুঝিয়ে দিয়েছেন, কোনও অপশক্তির কাছে এই বাংলাদেশ কখনও নত হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy