মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
বঙ্গবন্ধু-সহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে শক্ত নিরাপত্তা বলয়ের মাঝে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের বিচার শুরু হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি জনগণের চাপের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধু-সহ অন্যান্য আসামীকে মুক্তি দেয়। পরদিন রেসকোর্স মাঠে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১০ লাখের বেশি জমায়েতের এক সংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়ার কথা ঘোষণা করে।
১০ মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে বসেন বঙ্গবন্ধু। সেই গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামি লিগের ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি তুলে তিনি বলেন, ‘গণ-অসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।’ বঙ্গবন্ধুর দাবি অগ্রাহ্য করাতে ১৩ মার্চ তিনি গোলটেবিল বৈঠক ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন।
২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করেক্ষমতাসীন হন। ৫ ডিসেম্বর সুরাবর্দির মৃত্যুদিবসে আওয়ামি লিগের সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। সেদিন তিনি সরাসরি বলেন, ‘জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।
১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আবারও আওয়ামি লিগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ৭ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামি লিগ পুরো পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন পায় দলটি।
আসে বাঙালির স্বাধীনতার বছর ১৯৭১।জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকার রেসকোর্স মাঠের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। জাতীয় পরিষদের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২৮ জানুয়ারি জুলফিকার আলি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তিনদিনের এই বৈঠকে ব্যর্থ হলে১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। এদিকে ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা করে দুই প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি তোলে।
১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের ঘোষণা করলে আগুন জ্বলে ওঠে। ৭ মার্চ রেসকোর্সে এদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন,‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। এই এক ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি স্পর্শ করে তার নিজস্ব স্বাধীন ভূমিখণ্ড। ‘প্রত্যেকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে।’ তিনি এ কথাবলার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য প্রস্তুতি।
পুরো বাংলদেশ চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকেআলোচনার জন্য ভুট্টোও ঢাকাতে আসেন। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ারা ঢাকা ছাড়েন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে। ২৫ মার্চ রাতে বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে, শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহ গণহত্যা—অপারেশন সার্চলাইট। পাকিস্তানি সেনারা কামান, ট্যাঙ্ক নিয়ে হামলা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতর। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন:
‘This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours.” এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ট্রান্সমিটারে পাঠানো হয়েছিল।
এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলায় একটি ঘোষণা পাঠান, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোষ নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামি লিগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান বেতারে তাৎক্ষণিক বিশেষ ব্যবস্থায় সারাদেশে পাঠানো হয়। রাতেই এই বার্তা পেয়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি সেনা ও অফিসাররা প্রস্তুত হতে শুরু করেন স্বাধীনতার জন্য। এই রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১-১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং ২৬ মার্চ তাকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যায়। ২৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেন।
১০ এপ্রিল মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সরকারে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় এই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা ছিল অনন্য। প্রায় এক কোটি শণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত হয়ে আছে।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয়ী হয়। অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
যুদ্ধ চলাকালে ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের লায়ালপুর সামরিক জেলে বঙ্গবন্ধুকে গোপন বিচারে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন চাপ দিতে থাকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য। বিশ্বের আরও অনেক দেশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশে আহ্বান জানায়।
১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধুকে লন্ডন পাঠান হয়। ৯ জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার সময়ে তিনি দিল্লিতে থামেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গাঁধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।
বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছেবিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে ভাষণ দেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি সেখানে যান। এই বছরের ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়।
১৫ অগস্ট ভোরে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের বাড়িতে সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারের হাতে নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা, জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, পুত্র শেখ জামাল, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নীপতি ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভ্রাতুষ্পুত্রশহিদ সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল আহমেদ-সহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়দের ঘাতকরা হত্যা করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাংলাদেশের বাইরে থাকাতে প্রাণে বেঁচে যান।
১৯৯৬-এর ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে। এরপর মুজিবেরহত্যাকারীদের বিচার শেষে দণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১০-এর ২৮ জানুয়ারি। ওইদিন বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হলেও এখনও কয়েকজন ঘাতক লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের বাইরে।তাদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
১০০ বছর আগে যে জনপদ ছিল পিছিয়ে থাকা, পরাধীন, সেই জনপদের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন একজন দীর্ঘকায় বাঙালি। ৭ মার্চ যাঁর আহ্বানে নিরস্ত্র বাঙালি পরিণত হয়েছিল সশস্ত্র যোদ্ধাতে। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হওয়ার শতবর্ষের সেই দীর্ঘযাত্রা আসলে বাঙালির প্রকৃত স্বাধীনতার আখ্যান।
(তথ্যসূত্র:জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের প্রকাশনা।)