Advertisement
১০ মে ২০২৪

জরুরি রক্ষাকবচও

জিনিসপত্র কিনতে দোকানে গেলে সব ভাল করে নেড়েচেড়ে বুঝে নেন। অথচ স্বাস্থ্য বিমার ব্যাপারে এত গা-ছাড়া ভাব কেন? একটু আগে থেকে ভেবে কিনলে কিন্তু গাঁটের কড়ি বেরিয়ে যাওয়া আটকানো সম্ভব।জিনিসপত্র কিনতে দোকানে গেলে সব ভাল করে নেড়েচেড়ে বুঝে নেন। অথচ স্বাস্থ্য বিমার ব্যাপারে এত গা-ছাড়া ভাব কেন? একটু আগে থেকে ভেবে কিনলে কিন্তু গাঁটের কড়ি বেরিয়ে যাওয়া আটকানো সম্ভব।

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

অনেক কিছুই ঠেকে শিখি আমরা। আর ওই শিখতে শিখতেই তৈরি হয়ে যায় জীবন বোধ। যা বেঁচে থাকার আগে পর্যন্ত গেঁথে থাকে মনের মধ্যে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিমার ক্ষেত্রে ঠেকে শিখতে গেলে বিপদ। গুচ্ছের টাকা বেরিয়ে যাবে চোখের পলকে। তখন হয়তো আপনি বা আপনার প্রিয় জন হাসপাতালের বিছানায়। টাকা পয়সার হিসেব-নিকেশে মন দেওয়ার ইচ্ছে নেই। অথচ ভাবতে হচ্ছে ফিক্সড ডিপোজিটটা ভাঙাব কি না। মিউচুয়াল ফান্ডের টাকাটা কত তাড়াতাড়ি পাব। শেয়ারগুলো বেচলে কি আপাতত ঝড়টা সামাল দেওয়া যাবে! একটা নতুন বোধ জন্ম নেয় ঠিক তখনই— ‘‘ইস্‌, একটু আগে যদি এটা ভাবতাম।’’ কিন্তু ততক্ষণে হয়তো দেরি হয়ে গিয়েছে বিস্তর। হাসপাতালের বিল লাখ খানেক ছাড়িয়ে গিয়েছে। জীবনভর একটু একটু করে গড়ে তোলা সঞ্চয় ফের পৌঁছে গিয়েছে বিন্দুতে। তাই স্বাস্থ্য বিমা স্রেফ চিকিৎসার খরচ জোগাড়ের ব্যবস্থা নয়, সঞ্চয়ের রক্ষাকবচও।

স্বাস্থ্য বিমা নিয়ে কথা বলার সময় শুরুতেই কয়েকটা বিষয় মাথায় এক্কেবারে চিরদিনের জন্য ঢুকিয়ে নেব। যেমন—

সঞ্চয় নয়: স্বাস্থ্য বিমার সঙ্গে সঞ্চয় বা লগ্নিকে গুলিয়ে ফেললে মুশকিল। ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদের পরে রিটার্ন আশা করবেন না।

নয় কর বাঁচানোর পথও: অনেকে শুধু কর ছাড় পেতে মন দেন এতে। যেন এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য। কেন কিনলেন, কী কিনলেন, কতটা প্রয়োজন মিটবে, সে সব পরখ করে নেওয়ার ধার ধারেন না। এর হাত ধরে কিছুটা কর কমলেই খুশি তাঁরা। অথচ সেটা করলে স্বাস্থ্য বিমা কখনওই নিজের ও পরিবারের বিপদ সামলানোর ঢাল হয়ে উঠবে না।

সংস্থাই দিচ্ছে: সংস্থাগুলি তাদের কর্মীদের অনেক সময় চিকিৎসা বিমার সুযোগ দেয়। কিন্তু শুধু তার ভরসায় থাকলে পরে পস্তাতে হতে পারে। চাকরি বদলালে সেই সুযোগও অদৃশ্য হবে। তখন ফের নতুন করে শুরু করতে হবে। এতে সময় নষ্ট হয়। ১০ বছর কোনও সংস্থায় চাকরি করার পরে যিনি তা বদলাচ্ছেন, তার নতুন বিমা শুরু করার বয়সও তো ১০ বছর পিছিয়ে গেল। তখন প্রিমিয়ামও বেশি গুনতে হবে। অথচ ১০ বছর আগে কর্পোরেট বিমার বাইরে আর একটি কিনে রাখলে খরচ হত কম।

বেশি বয়সে প্রিমিয়ামও বেশি: যত বেশি বয়সে বিমা শুরু করবেন, প্রিমিয়াম হবে তত চড়া। তার উপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগভোগও বাড়ে। তাই তাড়াতাড়ি পলিসি কিনে ফেলাই কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ।

কাজে লাগার মতো: কোনও হিসেব-নিকেশ ছাড়া খুব কম টাকার স্বাস্থ্য বিমা করলে প্রয়োজনের সময় বিপদে পড়তে পারেন। কারণ, একে তো চিকিৎসার খরচ প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে। তার উপর জটিল রোগভোগ বা অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে তা আরও অনেক বেশি হয়। শুরুতেই এই কথাটা মাথায় রাখা জরুরি।

চাহিদার ফিতে: কোন ধরনের প্রকল্প কিনবেন বা কত টাকার বিমা করবেন, তা নির্ভর করবে পুরো পরিবারের প্রয়োজনের উপরে। যেমন, শুধু নিজের জন্য হলে এক রকম। স্ত্রী/স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে ফ্লোটার প্রকল্প কিনলে আর এক রকম। আবার পরিবারে স্বামী/স্ত্রী, সন্তানের পাশাপাশি যদি বাবা-মায়ের মতো বয়স্ক মানুষ থাকেন, তা হলে পরিকল্পনা হবে অন্য রকম। কারণ—

• মা, বাবা সমেত সকলকে একটি ফ্লোটার স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্পের আওতাভুক্ত করতে চাইলে প্রিমিয়াম দিতে হবে অনেক বেশি। যেহেতু ফ্লোটারে সব থেকে বেশি বয়সের যে মানুষটি থাকেন, তাঁর উপর ভিত্তি করেই প্রিমিয়ামের অঙ্ক ঠিক হয়।

• তা ছাড়া, বয়স্কদের রোগে ভোগার আশঙ্কাও থাকে অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে বারবার বিমার টাকা দাবি করতে হতে পারে শুধু তাঁদের জন্যই। ফলে ওই বিমার আওতায় পরিবারের বাকি যাঁরা থাকবেন, তাঁদের চিকিৎসার খরচ চালানোর সুযোগ ক্রমশ ছোট হতে থাকবে।

• ফলে বিমার সুযোগ যদি সত্যিই কাজে লাগাতে হয়, তবে স্বামী/স্ত্রী, সন্তান ও নিজের জন্য একটি ফ্লোটার প্রকল্প ও বাবা-মায়ের জন্য আলাদা একটি প্রকল্প কিনলে সুবিধা হবে।

কোথায় কতটা বাদ: বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্পে কিন্তু অনেক কিছু বাদও থাকে। তাই কোথায় কোনটা পাবেন না, সেটা জেনে রাখা দরকার।

সাব-লিমিট: অনেক প্রকল্পে সাব-লিমিট বলে একটি বস্তু থাকে। যেখানে ডাক্তার, হাসপাতালের ঘর বা বেড ভাড়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতো বিভিন্ন খাতে বা নানা রকম রোগের জন্য নির্দিষ্ট টাকা বরাদ্দ থাকে। যেমন ধরুন, কিডনির পাথর অপারেশন করতে হয়তো ১ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে।

কিন্তু এই ধরনের রোগের জন্য আপনার পলিসিতে সর্বোচ্চ ৪০,০০০ টাকার সাব-লিমিট। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে বাকি ৬০,০০০ বিমা থেকে পাবেন না। নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে।

প্রকল্পের তুলনা: বিমা পলিসি কেনার সময় বিভিন্ন শর্ত অনুযায়ী ধরে ধরে বাজারে চালু প্রকল্পগুলির মধ্যে তুলনা করে দেখা উচিত। কোন ধরনের শর্ত আপনার পক্ষে অসুবিধার, কোন নিয়মটাই বা মেনে নিলে চাপ হবে না যাচাই করে নেওয়া ভাল।

নগদহীন: স্বাস্থ্য বিমায় ক্যাশলেস বা নগদহীন চিকিৎসার সুবিধা খুব জরুরি। বড় মাপের রোগের ক্ষেত্রে ডাক্তার, অপারেশন, চিকিৎসার পেছনে বহু টাকা খরচ হয়ে যায়। যে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বা করছেন কাউকে, তার সঙ্গে আপনার বিমা সংস্থার ক্যাশলেস লেনদেনের সুবিধা সংক্রান্ত চুক্তি না থাকলে ঘর থেকে টাকা বার করতে হবে। পরে হয়তো রিইমবার্স করিয়ে ওই টাকা ফেরত পাবেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক সঞ্চয় প্রকল্প অকালে নষ্ট হল। ফের নতুন করে শুরু করতে হবে। আসলে গ্রাহককে এই সুবিধা দিতে প্রতিটি বিমা সংস্থারই বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গে গাঁটছড়া থাকে। যে সংস্থার প্রকল্প কিনবেন, তার সঙ্গে জোট বাঁধা হাসপাতালগুলি থেকে চিকিৎসা শেষে ছাড়া পাওয়ার সময় রোগীকে কোনও টাকা মেটাতে হয় না। সে ক্ষেত্রে বিল সরাসরি মিটিয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট বিমা সংস্থাটিই। আপনাকে শুধু রোগ, চিকিৎসা, হাসাপাতালে ভর্তি ইত্যাদির নথি জমা দিতে হবে। কাজেই পলিসি কেনার আগে দেখে নেওয়া জরুরি, সংস্থার হাসপাতালের তালিকায় আপনার পছন্দেরটি আছে কি না।

গোল বাঁধে পুরনো রোগে: হতে পারে পলিসি করানোর আগেই আপনার দু’তিনটি রোগ মাথাচাড়া দিয়েছে। যাকে বিমার পরিভাষায় বলে প্রি-এগজিস্টিং ডিজিজ। বিমার টাকা পাওয়া নিয়ে যে সব সমস্যা হয়, তার একটা বড় অংশ এই পুরনো রোগ-ভোগ ঘিরেই। কেউ যদি ওই সব রোগ গোপন করে বিমা করেন, তা হলে পরে চিকিৎসা খরচের দাবি আটকে যেতে পারে।

অপেক্ষা করতে হয়: কিছু কিছু রোগ আবার পলিসি কেনার দুই থেকে চার বছরের মধ্যে বিমার সুবিধা পায় না।

বোনাস আছে কিন্তু: পলিসির মেয়াদের মধ্যে বিমাকারী কোনও দাবি না জানালে স্বাস্থ্য বিমা সংস্থাগুলি বোনাস দেয়।

দু’ভাবে পাবেন: বোনাস দু’ভাবে দেওয়া হতে পারে। বিমামূল্য (সাম ইনশিওর্ড) কিছুটা বাড়িয়ে। অথবা বিমা রিনিউ (নবীকরণ) করার সময় প্রিমিয়ামে ছাড় দিয়ে। পলিসি কেনার আগে দেখে নিন কোনটাতে সব থেকে বেশি লাভবান হবেন আপনি।

মনে রাখুন: প্রকল্প চালুর পরে অপেক্ষা করতে হয় কিছু দিন। সেই সময়ে প্রয়োজন পড়লেও চিকিৎসা খরচের টাকা দেওয়ার কথা নয় বিমা সংস্থার। এটি ওয়েটিং বা কুলিং পিরিয়ড। পলিসি কেনার পরে সাধারণত ৩০ দিন হয় তার মেয়াদ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়ম আলাদা হতে পারে। তবে এই অপেক্ষার সময়ে প্রথম বার কোনও রোগ ধরা পড়লে, তা কিন্তু বিমা শুরুর আগের রোগ (প্রি এগজিস্টিং ডিজিজ) বলে গণ্য হবে না।

ঝুঁকি কমাতে: যে পলিসির ওয়েটিং পিরিয়ড যত কম, তা তত আকর্ষণীয়। পলিসি কেনার আগে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। ক্ষতিপূরণ দাবির জন্য অপেক্ষার সময় কম হলে নিজের পকেট থেকে খরচের ঝুঁকি কমে।

আগের খরচ: হাসপাতালে ভর্তির আগে বহু খরচ বইতে হয়। স্বাস্থ্য বিমা থেকে সেই টাকা পাবেন তো? যেমন, যিনি ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তিনি আগে এক দফা খরচ করেছেন ডাক্তার দেখানো, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনে।

ছাড়া পাওয়ার পরে: হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও রয়েছে ডাক্তার দেখানো। পরের খরচের আওতায় পড়ে এগুলিই। পলিসি কেনার আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন সে সব খরচের কতটা কি কেমন করে পাওয়া যাবে। হাসপাতালে ভর্তির আগে ও ছাড়া পাওয়ার পরে কত দিন পর্যন্ত সেই খরচ দাবি করা যাবে, তা সংস্থা বিশেষে আলাদা হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই মেয়াদ যথাক্রমে ৩০ দিন এবং ৬০ দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE