শৈবাল বিশ্বাস
সুজিত (৪০) । স্ত্রী (৩৫) । ছেলে (৮) । মা (৬২)
বেসরকারি সংস্থার কর্মী | | স্ত্রী গৃহবধূ | | কলকাতায় বাড়ি | | উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে চান | | ইচ্ছে, বছরে এক বার বেড়াতে যাওয়া | | লক্ষ্য, অবসরের মোটা তহবিল
নিট আয় (মাসে) ১.৭২ লক্ষ | | মায়ের পেনশন ১৪,৫০০ খরচ (মাসে) ছেলের পড়া ১২,০০০ | | সংসার খরচ ১৮,৫০০ | | অন্যান্য ৫,০০০ | | গাড়ি বিমা ৫০০ | | স্বাস্থ্যবিমা ৯০৮ সঞ্চয় (মাসে) পিএফ ১,৮০০।।অটল পেনশন ২,২০০ | | | জমির কিস্তি ১৫,০০০ | | | এফডি ১.২০ লক্ষ
সম্পদ পিএফ ১.২৯ লক্ষ | | শেয়ার ৪.৫০ লক্ষ | | নগদ ৬ লক্ষ | | ইউলিপ ২৭ লক্ষ | | জমি ৩২ লক্ষ | | দিল্লির ফ্ল্যাট ৫৮ লক্ষ | | এফডি ৬৮ লক্ষ
মাস মাইনে, সংসার খরচ, দায়-দায়িত্ব সব মিলিয়ে প্রত্যেক প্রোফাইলই একে অন্যের থেকে আলাদা, কিন্তু তা-ও তাদের মধ্যে একটা মিল থেকেই যায়। প্রত্যেকেই চান আরও একটু ভাল থাকতে। অবসর জীবন যাতে নিশ্চিন্তে কাটানো যায়, তার ব্যবস্থা করতে। সন্তানের পড়াশোনা ও বিয়ের জন্য সঞ্চয় করতে এবং পরিবারকে সুখে রাখতে। সুজিতও সেরকমই এক জন।
তাঁর প্রোফাইল নিয়ে আলোচনা করব ঠিকই, কিন্তু একটু অন্য ভাবে। সুজিত জানতে চেয়েছেন তাঁর মতো বেতন পেলে ও সংসারের দায়িত্ব সামলাতে হলে আমি কী করতাম। তাঁর জুতোয় পা গলালে কোথায় যেত লগ্নির টাকা, তহবিলই বা বাড়ত কী ভাবে। তাই সে ভাবেই আজ বিশ্লেষণ করব। এখানে প্রথমেই যেটা বলে রাখা ভাল, তাঁর বেতন যথেষ্ট ভাল। খরচ একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই বাধা থাকে। তহবিলও মন্দ নয়। কিন্তু লগ্নির ধরন দেখলে বোঝা যাবে কোথাও খামতি থেকে গিয়েছে। বেছে নেওয়া হয়নি সঠিক প্রকল্প। তাই যে তহবিল আরও বাড়তে পারত, তা গড়ে ওঠেনি।
গোড়ায় গলদ
১) বেসরকারি সংস্থার কর্মী সুজিত মাস গেলে বেতন পান ১.৭২ লক্ষ টাকা। মায়ের পেনশন সাড়ে ১৪ হাজার। মাস গেলে লগ্নিযোগ্য তহবিল থাকে ১.২ লক্ষের বেশি। অথচ সেই টাকার প্রায় পুরোটাই তিনি ঢেলে দেন স্থায়ী আমানতে। বাকি টাকা যায় জমির দাম মেটাতে। অন্যান্য জায়গায় লগ্নি ছড়িয়ে দেওয়ার কোনও চেষ্টাও তাঁর প্রোফাইলে দেখা যায়নি। টাকা নেই বলে লগ্নি করতে পারব না— এই অজুহাত তাঁর ক্ষেত্রে খাটে না। অথচ তাঁর টাকা থেকেও, শুধুমাত্র পরিকল্পনা করে লগ্নি না-করায় তহবিল বাড়ানোর যে সুযোগ হেলায় হারিয়েছেন তিনি।
২) জেলা শহরে আদি বাড়ি ও গয়নাগাটি বাদ দিয়েও, সব মিলিয়ে সুজিতের সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি টাকার কাছাকাছি। অথচ তাঁর প্রোফাইল দেখে বোঝা যায় না,
তিনি সেই টাকা অবসরের জন্য রেখেছেন? নাকি তাঁর কিছু হলে
যাতে পরিবারের খরচ মেটাতে অসুবিধা না-হয়, সে জন্য জমিয়েছেন। মনে রাখতে হবে দু’টি লক্ষ্য কিন্তু আলাদা। অবসরের সঞ্চয় করলে ছেলের পড়াশোনা, সংসার চালানোর জন্য আলাদা টাকা জমাতে হবে সুজিতকে। আর জীবনবিমা হিসেবে তহবিল গড়ে থাকলে, তাঁর কিছু হলে ভবিষ্যতে স্ত্রী-ছেলের সংসার চালিয়ে সঞ্চয়ের জন্য টাকা না-ই থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে বেশি বয়সে গিয়ে সমস্যায় পড়তে পারেন তাঁরা।
৩) ইউলিপ পলিসি-র আওতায় তাঁর জীবনবিমার অঙ্ক মাত্র ১২ লক্ষ। যা কোনও ভাবেই যথেষ্ট নয়।
৪) স্থায়ী আমানত বাদ দিলে সুজিতের অধিকাংশ টাকা গিয়েছে জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটে। লগ্নি হিসেবে আকর্ষণীয় মনে হলেও, মনে রাখতে হবে এর ঝামেলা কিন্তু কম নয়।
জীবনবিমা
মাসে বেতন ১.৭২ লক্ষ টাকা। অথচ ইউলিপ পলিসির সাম অ্যাশিওর্ডের অঙ্ক ১২ লক্ষ!
এ অবস্থায় আমি থাকলে প্রথমেই জীবনবিমার অঙ্ক বাড়াতাম। খুব বেশি অঙ্কের বিমা প্রয়োজন নেই কারণ তহবিল যথেষ্ট জমেছে। কিন্তু তা-ও সব দিক বিবেচনা করে ২৫ বছরের জন্য অন্তত ৫০ লক্ষের টার্ম পলিসি করতাম। সঙ্গে নিতাম ক্রিটিক্যাল ইলনেস কভার এবং অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ বেনিফিটের দু’টি রাইডার।
ইতিমধ্যেই ইউলিপের সব প্রিমিয়াম দেওয়া হয়ে গিয়েছে সুজিতের। তাই এ নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। মেয়াদ শেষে হাতে আসা টাকা ছেলের উচ্চশিক্ষা বা নিজের অবসরের তহবিলে কাজে লাগানো যেতে পারে।
স্বাস্থ্যবিমা
অফিস থেকে ৫ লক্ষ ও নিজেদের আরও ৫ লক্ষ— মোট ১০ লক্ষের স্বাস্থ্যবিমা আছে সুজিতের। আমি হলে আগামী দিনে চিকিৎসার খরচের কথা বিচার করে এই বিমার অঙ্ক আরও বাড়াতাম। এক ধাক্কায় বেশি না-বাড়িয়ে প্রতি সুযোগে অল্প অল্প করে। একই সঙ্গে মায়ের বিমার অঙ্কও বাড়ানোর কথা ভাবতাম।
জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট
কলকাতায় নিজেদের বাড়ি। সেখানেই সুজিত থাকেন পরিবারের সঙ্গে। এ ছাড়াও আছে জেলা শহরে আদি বাড়ি, দিল্লিতে ফ্ল্যাট এবং কলকাতায় তিনটি জমিও (সব মিলিয়ে ১০ কাঠা)।
এর মধ্যে জেলা শহরের বাড়ি তিনি বিক্রি করবেন না বলেই জানিয়েছেন। অন্য দিকে দিল্লির ফ্ল্যাট ঋণমুক্ত। কিন্তু কলকাতায় জমির জন্য মাসে ১৫,০০০ টাকা করে দিতে হয়।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে এত বেশি অর্থ জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটে আটকে রাখার পক্ষপাতী নই। লগ্নির জন্য ফ্ল্যাট
কেনা তা-ও ঠিক আছে। কিন্তু জমি ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করতে প্রচুর সময় দিতে হয়। তা জবরদখল
হয়ে যাওয়ারও ভয় থাকে। আগামী দিনে যদি সেই জমিতে ডেভেলপারকে দিয়ে ফ্ল্যাট তৈরি করানো যায়, তা-হলে ভাল। কিন্তু মনে রাখতে হবে ফ্ল্যাট দেখাশোনা, বিক্রি করার অনেক ঝামেলা রয়েছে। এই সব ঝক্কি নিতে না-চাইলে তা সরাসরি বিক্রির কথা ভাবতে হবে।
স্থায়ী আমানত
সুরক্ষার দিক থেকে স্থায়ী আমানত খুবই ভাল। প্রয়োজনের সময় টাকাও হাতে আসে এই প্রকল্প থেকে। কিন্তু যে কোনও স্থায়ী আমানতই করযোগ্য। যে কারণে কর বাদ দিয়ে মেয়াদ শেষে হাতে আসা টাকা মূল্যবৃদ্ধিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। তা-ই এর উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়া উচিত বলে মনে করি না আমি। পাশাপাশি, ইতিমধ্যেই ব্যাঙ্কের আমানতে সুদ কমার পালা শুরু হয়েছে। আগামী দিনে যা আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে সুজিতের জায়গায় আমি থাকলে এখন থেকে স্থায়ী আমানতের বদলে বিভিন্ন ধরনের মিউচুয়াল ফান্ডকেই বেছে নিতাম ভবিষ্যৎ লগ্নির জন্য।
বিদেশে ছেলের উচ্চশিক্ষা
প্রথমেই দেখব কোন সময়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর কথা ভাবা হচ্ছে। তার পর সেই অনুসারে সিদ্ধান্ত নেব।
ধরুন, স্নাতক স্তরে ছেলেকে বিদেশে পড়াতে চাইছি। সাধারণ ভাবে বিদেশের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এ ক্ষেত্রে স্কলারশিপ দিতে চায় না। সেই কারণে—
• প্রথমে দেখব কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয় রয়েছে।
• সেখানে পড়া-থাকা-খাওয়ার খরচ কী রকম ইত্যাদি।
• এখনকার খরচের সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি হিসাব করে দেখব ১০ বছর পরে (ছেলের এখন বয়স ৮ বছর) কত খরচ হতে পারে।
• তহবিলের অঙ্ক দেখে শেয়ার ভিত্তিক (ইকুইটি) ফান্ডে এসআইপি শুরু করব।
• প্রতি ৩ বছরে তহবিল খতিয়ে দেখে লগ্নির ধরন পাল্টানো যেতে পারে।
যদি স্নাতকোত্তর স্তরে বিদেশে পাঠাতে চাই, সে ক্ষেত্রে পছন্দের বিষয়ে কোথায় কী স্কলারশিপ রয়েছে, তা আগে খুঁটিয়ে দেখব। ভাল কলেজ বেছে সেই অনুসারে সিদ্ধান্ত নেব।
সচ্ছল অবসর
ছেলের পড়াশোনার জন্য টাকা রেখে এবং মেডিক্লেমের পরিমাণ বাড়ানোর পর এ বার নজর থাকুক অবসরের তহবিল গড়ার দিকে।
• বয়স এখন ৪০। যদি ৬৫ বছরে অবসর নিতে চাই, তা হলে তহবিল তৈরির জন্য এসআইপি করা ছাড়া গতি নেই। তাই প্রকল্প বাছাইয়ের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে হাতে থাকা টাকার ৭০% ঋণপত্র নির্ভর (ডেট) এবং শেয়ার ভিত্তিক (ইকুইটি) ফান্ডে ভাগ করে রাখতাম। প্রতি পাঁচ বছরে সব প্রকল্পের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে তবেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে হাঁটতাম।
• ইতিমধ্যেই ৪.৫ লক্ষ টাকা শেয়ারে লগ্নি করা হয়েছে। কিন্তু বাজার অস্থির দেখে তা বন্ধ রয়েছে। কিন্তু ভেবে চিন্তে তা ফের শুরুর পক্ষপাতি আমি। তাই প্রতি মাসে অল্প কিছু টাকা সরাসরি শেয়ারে ঢালার পথে হাঁটা উচিত। যত দিন যাবে, ততই ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা কমবে। ফলে এখনই সঠিক সময় শেয়ারে লগ্নির।
• পিএফ নামমাত্র। সেই কারণে প্রতি বছর ১.৫ লক্ষ টাকা পিপিএফে জমা করতাম আমি। চলতি অর্থবর্ষ থেকে কেন্দ্র এই প্রকল্পে সুদের হার কমিয়ে ৮.১% করেছে ঠিকই, তা সত্ত্বেও করমুক্ত হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে বেশ বড় অঙ্কের তহবিল গড়ে উঠতে পারে।
• প্রতি বছরে ৫০ হাজার টাকা করে এনপিএসে রাখা উচিত বলেও আমি মনে করি। ৪০% টাকার উপর কর ছাড় দেওয়ার কথা বাজেটেই ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। পাশাপাশি, এই প্রকল্পে বছরে ৫০ হাজার টাকা লগ্নির উপরে কর বাঁচানো সম্ভব। ফলে অবসরের তহবিল তৈরিতে তা সাহায্য করবে।
• যে টাকা স্থায়ী আমানতে ইতিমধ্যেই জমা হয়েছে, তা অবসরের সময় কাজে আসবে। কিন্তু নতুন করে সেখানে টাকা রাখার প্রয়োজন নেই।
বেড়াতে যাওয়া
আমি নিজে ঘুরতে যেতে ভালবাসি, সে জন্য আলাদা করে সঞ্চয়ও করি। সে ক্ষেত্রে আমার পছন্দ ঋণপত্র নির্ভর লিকুইড ফান্ড। মাসের শেষে যে টাকাই হাতে থাকুক না-কেন, তাই এখানে রেখে দিই। এতে বেড়াতে যাওয়ার আগেই টাকা তুলে নেওয়া যায়।
সুজিত চিঠিতে জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর জায়গায় থাকলে আমি কী করতাম। তাই সে ভাবেই আজকের আলোচনা করলাম। এ বার তাঁর ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছার উপরই নির্ভর করবে আগামী দিনে কোন পথে হাঁটবেন তিনি।
(অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy