এ বার হয়তো আধার নম্বর লাগবে সিনেমার টিকিট কাটার সময়ে, কিংবা রেস্তোরাঁর টেবিল বুক করতে। কিংবা যে কোনও দিন হয়তো আধার কার্ড দিতেই তা চেয়ে বসবে সরকার!
অবশ্যই ঠাট্টা। কিন্তু রোজকার জীবনের প্রতি পায়ে কেন্দ্র যে ভাবে আধার-কে ক্রমশ জুড়ে দিচ্ছে, তাতে এই অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে সর্বত্র। কথা উঠছে, ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে আয়কর জমা— সবখানে তাকে বাধ্যতামূলক করতে চাওয়া নিয়ে। অনেকের প্রশ্ন, তবে কি সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক-পরিচয়পত্র না হয়েও বকলমে তা-ই হয়ে উঠছে আধার? এর জন্য তথ্য সংগ্রহের সময়ে তা চুরি গেলে অথবা তথ্য-ভাণ্ডারে হ্যাকার সিঁদ কাটলে শাস্তি এত কম কেন, প্রশ্ন উঠছে তা ঘিরেও।
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘প্রশাসনের প্রয়োজনের বাইরেও অনেক ক্ষেত্রে আধার-তথ্য মেলানো হচ্ছে। এটা কার্যত ঘরে ঢুকে নজরদারির চেষ্টা।’’ অনেকে উদাহরণ হিসেবে বলছেন মোবাইলের সিমকার্ড কিংবা বিমানের টিকিট বিক্রির জন্য আধার-তথ্য মেলানোর ঘটনা।
রাজকোষের টাকায় দেওয়া ভর্তুকি, আর্থিক সুবিধা ও পরিষেবা— তিন ক্ষেত্রেই আধার তথ্যভাণ্ডার থেকে কারও সম্পর্কে তথ্য মেলানোর সুযোগ করে দিয়েছে মোদী সরকার। সরকারি দফতর ছাড়াও এই অনুমতি পেয়েছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি। কিন্তু আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘পরিষেবা’ কথাটির ব্যাপ্তি অনেক। তার আওতায় আসতে পারে অনেক কিছু। তাই আধারের অপব্যবহার রুখতে আগে ওই সংজ্ঞা স্পষ্ট করুক কেন্দ্র। নইলে কার্যত শোওয়ার ঘরেও ‘উঁকি দেওয়া যাবে’ আধার-তথ্যের হাত ধরে।
যেমন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিকাশ ভট্টাচার্য আয়কর ফাঁকি, বেআইনি লেনদেন রোখার মতো ক্ষেত্রেও আধার আবশ্যিক করার বিরোধী। তাঁর প্রশ্ন, এই সমস্ত বেআইনি কাজ রুখতে আইন ও তদন্ত সংস্থা রয়েছে। সেগুলির পরিকাঠামো জোরদার না-করে নতুন একটি ব্যবস্থা তৈরির যুক্তি কী? ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতেই বা সরকার নির্দেশিত নথির উপরে আধার লাগবে কেন? প্রশ্ন উঠছে দেশের প্রায় সমস্ত মানুষের এত মূল্যবান তথ্যের সুরক্ষা নিয়েও। আধার কার্ড তৈরির তথ্য সংগ্রহের সময়ে তা ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ক্রিকেটার এম এস ধোনি এর শিকার। তথ্যপ্রযুক্তি ও আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদও সংসদে আধার তথ্য ফাঁসের অভিযোগে প্রায় ৩৪ হাজার ‘অপারেটর’কে কালো তালিকাভুক্ত করার কথা জানান। ১,০০০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন। ফলে প্রশ্ন, এগুলি না হয় মূলত তথ্য সংগ্রহের সময়ের ঘটনা। আধারের মূল তথ্যভাণ্ডার হ্যাকার হানা থেকে কতখানি নিরাপদ?
আশঙ্কা আরও বাড়াচ্ছে তথ্য চুরিতে শাস্তির বহর। আধারের তথ্য বেআইনি ভাবে ফাঁস করলে, তিন মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। তথ্য ভাণ্ডারে সিঁদ কাটার চেষ্টার শাস্তি তিন মাসের জেল ও অন্তত ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা। জয়ন্তবাবুর মতে, এই শাস্তি নগণ্য। বিকাশবাবুর মতে, ‘‘তথ্য এক বার বেরোলে আর তা গোপন থাকল না।’’ তবে কেন্দ্রের দাবি, তথ্য সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। দু’জনেরই দাবি, আধার বাধ্যতামূলক হলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকে কল্যাণমূলক প্রকল্প ও পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। তাই সুপ্রিম কোর্ট তা বাধ্যতামূলক না করার রায় দেয়। কিন্তু রায় কার্যকরের ইঙ্গিত কেন্দ্রের তরফে মেলেনি।
মূলত ভর্তুকির অপচয় বন্ধ করা আর ব্যাঙ্ক-কে সকলের দরজায় পৌঁছনোর লক্ষ্যেই আধারের জন্ম। কিন্তু এখন সিনেমার টিকিটেও তাকে না-জোড়া পর্যন্ত কেন্দ্রের ছুটি নেই বলে রসিকতা করছেন অনেকে।