Advertisement
১৭ মে ২০২৪

ওয়েলস্পান কেনায় অন্ধকারে ছিল না গোষ্ঠী

আরও চড়ল টাটা-মিস্ত্রি স্নায়ুযুদ্ধের পারদ। নিজেকে সমর্থন করে এক দিন বাদে ফের মুখ খুললেন সাইরাস মিস্ত্রি। শুক্রবার বেশি রাতে আর একবার টাটা গোষ্ঠী, বিশেষ করে রতন টাটাকে আক্রমণ করে বিবৃতি দিলেন চেয়ারম্যান পদ থেকে সরতে বাধ্য হওয়া মিস্ত্রি।

সংবাদ সংস্থা
মুম্বই, নয়াদিল্লি ও গাঁধীনগর শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:১৮
Share: Save:

আরও চড়ল টাটা-মিস্ত্রি স্নায়ুযুদ্ধের পারদ। নিজেকে সমর্থন করে এক দিন বাদে ফের মুখ খুললেন সাইরাস মিস্ত্রি।

শুক্রবার বেশি রাতে আর একবার টাটা গোষ্ঠী, বিশেষ করে রতন টাটাকে আক্রমণ করে বিবৃতি দিলেন চেয়ারম্যান পদ থেকে সরতে বাধ্য হওয়া মিস্ত্রি। এ বার টাটা পাওয়ারের ওয়েলস্পান কেনা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ওড়ালেন তিনি। পাশাপাশি, দু’পক্ষের চাপান-উতোরের মধ্যেই পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, সে ব্যাপারে কেন্দ্র সজাগ দৃষ্টি রাখছে বলে শুক্রবার জানিয়েছেন কোম্পানি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল। তবে এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদী সরকার টাটা কাণ্ডে সরাসরি ‘হস্তক্ষেপ’ করতে চায় না বলেও জানিয়েছেন তিনি। কারণ এটি একটি বেসরকারি গোষ্ঠীর ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’। তা ছাড়া বিষয়টি ইতিমধ্যেই আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

টাটা গোষ্ঠীর দাবি ছিল, জুন মাসে টাটা পাওয়ারের ওয়েলস্পানের সৌর বিদ্যুৎ ব্যবসা অধিগ্রহণের ব্যাপারে কার্যত অন্ধকারে রাখা হয় পরিচালন পর্ষদকে। টাটাদের অভিযোগ, এ ব্যাপারে তাদের ঠিক মতো তথ্য দেননি মিস্ত্রি। এর বিরুদ্ধে এ দিন মিস্ত্রি জানান, ‘‘এটা আশ্চর্যের বিষয়, রতন টাটা আমাকে নিয়ে তাঁর সোমবারের সিদ্ধান্ত সমর্থন করতে অস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছেন। ওই সব বিবৃতি তাঁর কাছে থাকা তথ্যের পরিপন্থী ও টাটা গোষ্ঠীর হাতে থাকা নথিপত্রের সঙ্গেও খাপ খায় না। কারণ, টাটাদের সূত্রে অভিযোগ ছিল, টাটা ট্রাস্টের অছিদের ওয়েলস্পান পাওয়ারের সঙ্গে লেনদেন সম্পর্কে জানানো হয়নি। কিন্তু সব নথিই গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান এমেরিটাস হিসেবে পাঠানো হয়েছিল রতন টাটাকে।’’

এ দিন মিস্ত্রির আরও দাবি, ২০১৬-র ৩১ মে তারিখেই টাটা সন্স-এর পরিচালন পর্ষদ ও রতন টাটার কাছে ওয়েলস্পানের সঙ্গে প্রস্তাবিত লেনদেন সম্পর্কে বিবৃতি পাঠানো হয়। সেই সঙ্গেই সকলের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাঁরা আর কোনও তথ্য চান কি না।

মিস্ত্রির কথায়, ‘‘একমাত্র উত্তরটি এসেছিল টাটা সন্স পর্ষদে টাটা ট্রাস্টস-এর মনোনীত ডিরেক্টর বিজয় সিংহের কাছ থেকে, যিনি বিষয়টির প্রশংসা করেন। বাকি সকলেই ছিলেন চুপ। এর পরে টাটা পাওয়ারের সঙ্গে ওয়েলস্পানের চুক্তি হয় ১২ জুন।’’ নিজেকে সমর্থন করতে গিয়ে মিস্ত্রি আরও বলেছেন, ২০১৬-র গোড়াতেই টাটা সন্স-এর কাছে টাটা পাওয়ার উপস্থাপনা মারফত জানিয়েছিল, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির উপর জোর দেবে সংস্থা। সেই সিদ্ধান্ত পর্ষদের প্রশংসাও কুড়িয়েছিল। মিস্ত্রি বিবৃতিতে আরও দাবি করেছেন, ‘‘চুক্তি হওয়ার পরে ৩০ জুন টাটা পাওয়ারের সিইও অনিল সারদানা টাটা সন্স পর্ষদের সামনে ফের বিষয়টির উপস্থাপনা করেন। পর্ষদ সর্বসম্মত ভাবে লেনদেনে সিলমোহর দিয়েছিল।’’

এ দিকে কোম্পানি বিষয়ক দফতরের প্রতিমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা মেঘওয়াল আজ গাঁধীনগরে এক সভায় টাটা-কাণ্ডে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছেন, মূলধনী বাজার দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) এ নিয়ে কেন্দ্রের কাছে এখনও কোনও আর্জি জানায়নি। তবে সেবি ভবিষ্যতে সরকারকে বিষয়টির উপর নজরদারির অনুরোধ জানালেই তাঁরা এ ক্ষেত্রে ‘পদক্ষেপ করবেন’। টাটার মতো একটি বড় গোষ্ঠীর বিষয় বলেই মুম্বই হাউসের প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কেই কেন্দ্র সজাগ রয়েছে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।

পাশাপাশি, উপদেষ্টা সংস্থা আইআইএএস এ দিনই এক সমীক্ষায় হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, বিপুল সংখ্যক শেয়ারহোল্ডারের কাছে টাটা গোষ্ঠী দায়বদ্ধ। তাই সাইরাস মিস্ত্রিকে সরানোর কারণ স্পষ্ট করতে হবে তাদের। না-হলে জনসাধারণ ও শেয়ারহোল্ডারদের আস্থা হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে টাটাদের। তারা আরও জানিয়েছে, টাটা গোষ্ঠী থেকে আচমকা মিস্ত্রিকে সরতে হওয়ার ঘটনায় শেয়ারহোল্ডাররা বিভ্রান্ত। তাই তাঁদের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখতে হবে গোষ্ঠীকে। এই প্রক্সি অ্যাডভাইজরি সংস্থা আইআইএএস বলেছে, সংস্থা অন্দরের সমস্যা প্রকাশ্যে না-আনার পক্ষে যুক্তি দেখালেও টাটা গোষ্ঠীর তরফে এ নিয়ে নীরবতা কাম্য নয়। কারণ বল এখন হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। আর তা থামানোর সুযোগ নেই। প্রসঙ্গত, মূলত বিভিন্ন সংস্থার বার্ষিক সভায় শেয়ারহোল্ডারদের ভোট দেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকে প্রক্সি অ্যাডভাইজরি সংস্থা। শেয়ারহোল্ডারের মতামতের ভিত্তিতে সমীক্ষাও প্রকাশ করে তারা। আইআইএএস সূত্রের খবর, তাদের সংস্থায় টাটা গোষ্ঠীর শেয়ারও রয়েছে। টাটা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড-এর মাধ্যমেই গোষ্ঠীর ওই ইকুইটি রয়েছে আইআইএএসে।

আইআইএএস তাদের সমীক্ষায় যে- সব প্রশ্ন তুলেছে, সেগুলির মধ্যে রয়েছে:

চেয়ারম্যান মিস্ত্রির কাজের মূল্যায়ন কোন মাপকাঠি মেনে হয়েছে।

টাটা মোটরস, ইন্ডিয়ান হোটেলস, টাটা স্টিল, টিসিএসের মতো গোষ্ঠীর নথিভুক্ত সংস্থায় মিস্ত্রি এখন আর চেয়ারম্যান থাকতে পারবেন কি না।

মিস্ত্রি টাটাদের কর্পোরেট সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি বলে অভিযোগ গোষ্ঠীর। তাঁর খামতি ঠিক কোথায়, সেটা স্পষ্ট করতে হবে টাটাদের

গোষ্ঠী পরিচালনায় ক্ষমতার নতুন বিন্যাস কেমন হবে, তা-ও জানাতে হবে।

প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যেই টাটা গোষ্ঠীর উপর নজর রাখতে শুরু করেছেন সেবি এবং বিভিন্ন শেয়ার বাজার কর্তৃপক্ষ। সেবি-র মূল উদ্বেগ টাটা গোষ্ঠী বাজারে নথিভুক্তি ও সংস্থা পরিচালনা সংক্রান্ত নিয়ম ভেঙেছে কি না, তা নিয়ে। পাশাপাশি, অলাভজনক খাতে লগ্নি করে টাটাদের ১.২০ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ মুছে যাওয়ার যে-অভিযোগ সাইরাস মিস্ত্রি এনেছেন, তা ঠিক কি না, জানতে চেয়েই গোষ্ঠীকে নোটিস পাঠিয়েছে দুই প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ বিএসই এবং এনএসই। বিশেষ করে স্টক এক্সচেঞ্জের নজরে রয়েছে টাটা মোটরস, টাটা স্টিল, ইন্ডিয়ান হোটেলস, টাটা টেলি, টাটা পাওয়ার।

সেবি জানিয়েছে, ঘটনা কোন দিকে মোড় নেয়, তার প্রতিটি পর্বই তারা খতিয়ে দেখছে। ২৪টিরও বেশি বিভিন্ন নথিভুক্ত সংস্থা মিলিয়ে ১০ হাজার কোটি ডলার বা ৬ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার টাটা গোষ্ঠীর পরিচালনায় কোনও আইন ভাঙা হয়েছে কি না, সেটাই তাদের বিচার্য বিষয় বলে জানিয়েছে সেবি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির এক অফিসার বলেন, ‘‘সংস্থা পরিচালনা, নথিভুক্তি, কিংবা সেবি-র আওতায় থাকা অন্য কোনও নিয়ম ভাঙা হয়েছে বলে কোনও ইঙ্গিত মিললেই আমরা ব্যবস্থা নিতে একটুও দেরি করব না।’’

ঘুরে দাঁড়াল টাটাদের শেয়ার। ধাক্কা সামলে নিয়ে ফের উত্থানের রাস্তায় ফিরল টাটা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার। গত তিন দিনে বাজারে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার শেয়ার-মূল্য খোয়ানোর পরে শুক্রবার টাটা মোটরস, টাটা টেলি-সহ বিভিন্ন সংস্থার দর ৬% পর্যন্ত বাড়ল। যার হাত ধরে সেনসেক্স উঠেছে ২৫.৬১ পয়েন্ট। দাঁড়িয়েছে ২৭,৯৪১.৫১ অঙ্কে। বাজার বিশেষজ্ঞদের দাবি, টানা পতনের ফলে কম দামে টাটাদের সংস্থার শেয়ার হাতে পাওয়ার হিড়িকেই কমেছে উদ্বেগ। সোমবার চেয়ারম্যান পদ থেকে সাইরাস মিস্ত্রিকে সরানোয় মঙ্গলবার থেকেই পড়ছিল সেগুলির দর।

টাটা স্টিলের দাবি। ইউরোপের ইস্পাত ব্যবসাকে চাঙ্গা করতে এখনও তারা থাইসেনক্রুপের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ গড়ার চেষ্টা চালু রেখেছে বলে শুক্রবার জানাল টাটা স্টিল। পাশাপাশি সংস্থার দাবি, ব্রিটেনের ইস্পাত ব্যবসার সমস্যা মেটাতেও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে চলছে আলোচনা। সম্প্রতি টাটা চেয়ারম্যানের পদ থেকে অপসারিত সাইরাস মিস্ত্রি তাঁর চিঠিতে ওই ইউরোপীয় ইস্পাত ব্যবসার খারাপ অবস্থার কথা উল্লেখ করার পরেই এই ব্যাখ্যা টাটাদের।

কানাডায় খনন চুক্তি। কানাডার কুবেক প্রদেশে খনন শুরুর জন্য চুক্তি করল টাটা স্টিল মিনারেল্‌স কানাডা। সংশ্লিষ্ট মহলের ইঙ্গিত, টাটা-মিস্ত্রি কাণ্ডের জের তাদের ব্যবসার উপর সে ভাবে পড়বে না। কুবেক প্রদেশে ৮৭৫ কোটি টাকা লগ্নিতে খনন কাজ চালাতে শুক্রবারই সেখানকার সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বলে বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছে টাটা স্টিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TATA Cyrus Mistry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE