Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Business News

আটকে টাকা, যাবেন কোথায়?

উৎপাদন বা পরিষেবা সংস্থা গড়ে ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন। লাগিয়েছেন সঞ্চয়ের টাকা। মাথায় ঋণের বোঝা। অথচ, রোজগারের টাকা আটকে রয়েছে বড় সংস্থার ঘরে। এই অবস্থায় আইন, সরকারি ব্যবস্থা কিন্তু রয়েছে আপনার পাশেই। জানাচ্ছেন দেবপ্রিয় সেনগুপ্তসমস্যা হয় যদি পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাম না পায় সংশ্লিষ্ট ছোট সংস্থাটি।

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৮:৪১
Share: Save:

ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পের হাতে পুঁজি এমনিতেই কম। মুনাফার অনুপাতও (মার্জিন) যে সব সময়ে বেশি থাকে, এমনটাও তো নয়! এর মধ্যে বহু মানুষ ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন। আর যাঁরা সেটা পান না, তাঁদের নিজস্ব পুঁজিকে বাজি রেখে স্বপ্নপূরণের পথে পা বাড়াতে হয়।

কিন্তু সমস্যা হয় যদি পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাম না পায় সংশ্লিষ্ট ছোট সংস্থাটি। সে ক্ষেত্রে টান পড়ে তার কার্যকরী মূলধনে। ঋণ বা নিজস্ব পুঁজি— মুশকিল হয় দুই ক্ষেত্রেই। ঋণ নিয়ে ব্যবসা করলে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণের কিস্তি মেটাতে না-পারলে সমস্যা প্রবল। আবার নিজের ঘর থেকে নেওয়া বা সঞ্চয় ভাঙানো পুঁজিই যদি হয় ব্যবসা চালানোর প্রধান সম্বল, তা হলে ওই পাওনা হাতে না-পাওয়ার ধাক্কায় তৈরি হতে পারে নগদের সমস্যা। হয় ব্যবসার অস্তিত্ব সঙ্কট। এই নিয়ে অনেক সময়েই সংশ্লিষ্ট দুই সংস্থা (বিক্রেতা ছোট সংস্থা ও তাদের কাছ থেকে পণ্য-পরিষেবা ক্রয়কারী বড় সংস্থা) মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ে। ছোট সংস্থার সমস্যা বাড়ে এতেও। কারণ, একে তো বকেয়া আটকে থাকে, উপরন্তু দীর্ঘ সময় ধরে আইনি প্রক্রিয়া চললেও জট বাড়ে। যা ছোট সংস্থার পক্ষে যথেষ্ট ঝুঁকির।

কী ভাবে ব্যবসা শুরু করবেন, সহজে ঋণ মিলবে কোন পথে— এই নিয়ে সম্প্রতি আমরা আলোচনা করেছি। কিন্তু বিক্রির টাকা আটকে থাকলে পদক্ষেপ কী হবে? সেই তথ্য জানাতেই আজকের নিবন্ধ।

সমাধানের লক্ষ্যে

এই সমস্যা থেকে ছোট সংস্থাগুলিকে কিছুটা রেহাই দিতে কেন্দ্রীয় আইনে একটি আধা বিচার বিভাগীয় পরিষদ গঠনের ভাবনা শুরু হয় ’৯০-এর দশকের গোড়ায়। তৈরি হয় আইন ও সেই পরিষদের কাঠামো। সেই অনুযায়ী, প্রথমে ছোট সংস্থার অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে নেওয়া হয়। তার পরে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিতর্ক মিটিয়ে নেওয়ার উপরে জোর দেওয়া হয়। তাতে জট না-খুললে সংশ্লিষ্ট কমিটি শুনানি করে সুদ সমেত বকেয়া মেটানোর নির্দেশ দেয় ক্রেতাকে। ওই রায় নিয়ে আপত্তি থাকলে ক্রয়কারী সংস্থা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে কড়া কিছু শর্ত মেনেই এগোতে হবে তাকে।

এ বার দেখে নিই, বকেয়া নিয়ে সমস্যায় পড়লে ছোট উদ্যোগপতিরা কোথায় দরবার করতে পারেন।

সুবিধার আওতায় কারা

উৎপাদনমুখী ক্ষেত্রে কারখানা ও যন্ত্রাংশে লগ্নি
• ক্ষুদ্র: ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত
• ছোট: ২৫ লক্ষ টাকার বেশি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত
পরিষেবা ক্ষেত্রে যন্ত্রে লগ্নি
• ক্ষুদ্র: ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত
• ছোট: ১০ লক্ষ টাকার বেশি থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত

কোথায় আবেদন

ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পের বকেয়া আদায় সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে ১৯৯৩ সালে একটি আইন আনে কেন্দ্র। তার পরে সেই আইন মোতাবেক তৈরি হয় পূর্বতন সেই পরিষদ, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রি ফেসিলিটেশন কাউন্সিল’। ২০০৬ সালে নতুন আইনের পরে সেটির নাম হয়েছে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট মাইক্রো অ্যান্ড স্মল ফেসিলিটেশন কাউন্সিল’।

কাদের জন্য

এই মঞ্চে আর্জি জানাতে পারবে কারা? সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্প সংস্থা তাদের ক্রেতার কাছ থেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বকেয়া না-পেলে এই কাউন্সিলের দ্বারস্থ হতে পারে। মাঝারি শিল্প কিন্তু এই মঞ্চ থেকে সুবিধা নিতে পারবে না।

সংজ্ঞা ঝালাই

কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী এই শিল্প ক্ষেত্রকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়। ১) উৎপাদনমুখী ক্ষেত্র এবং ২) পরিষেবা ক্ষেত্রে। দুই ক্ষেত্রেই যে সব ক্ষুদ্র ও ছোট সংস্থা বকেয়া আদায়ের জন্য এই পর্ষদে আর্জি জানাতে পারবে, তাদের সংজ্ঞা এই রকম—

ব্যবসায়ীরা নন

সমাধানের এই মঞ্চ শুধু মাত্র ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পের জন্য। ক্রেতার কছে বকেয়া থাকলেও ব্যবসায়ীরা (ট্রেডার) এই কাঠামোর সুবিধা কোনও ভাবেই পাবেন না। কাউন্সিলে এমন আর্জি এলে তা খারিজ হয়ে যাবে। অনেক ব্যবসায়ীই উদ্যোগ আধার মেমোরেন্ডাম (ইউএএম) নিয়ে থাকেন। কিন্তু কাউন্সিলে যখনই কোনও সংস্থা আবেদন জানায়, আবেদন গ্রহণ করার আগে তাদের ইউএএম জেলার শিল্প কেন্দ্রের (ডিআইসি) কাছে যাচাই করে নেওয়া হয়।

কাউন্সিলের কমিটি

রাজ্যের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প ডিরেক্টরেটের অধিকর্তা এই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট শিল্প মহলের তিনটি সংগঠনের প্রতিনিধি এবং এক জন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কমিটিতে থাকেন। সাধারণত বিভিন্ন অভিযোগ আলোচনার মাধ্যমে মেটানোর জন্য মাসে তিন-চার দিন বসে কাউন্সিল। এ ছাড়াও সালিশির জন্য আরও দু’দিন বসেন সদস্যেরা।

মেটানোর সময়সীমা

নিয়ম অনুযায়ী কোনও ক্ষুদ্র বা ছোট সংস্থা পণ্য কিংবা পরিষেবা বিক্রি করলে, তার ইনভয়েস বা বিল জমার পর থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ক্রেতাকে তার দাম মেটাতে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই ৪৫ দিনের সময়সীমা শুরু হওয়ার আলাদা নিয়ম রয়েছে। যেমন, অনেক সময়েই পণ্য বা পরিষেবা হাতে পাওয়ার পরে তার মান ঠিক কি না, কিংবা চাহিদা অনুযায়ী তৈরি হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখে নেয় ক্রেতা (অনেক ক্ষেত্রে সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা)। যদি দেখা যায়, পণ্য বা পরিষেবায় ত্রুটি রয়েছে, তা হলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে তা ১৫ দিনের মধ্যে জানাতে হবে। তার পরে আর কোনও আপত্তি তোলা যাবে না।

কাউন্সিলে আবেদন

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বকেয়া না-পেলে সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র বা ছোট সংস্থা কাউন্সিলে আবেদন জানাতে পারে। এখন বাধ্যতামূলক ভাবে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের পোর্টালে (samadhaan.msme.gov.in) সেই আবেদন জানাতে হয়। তবে কাউন্সিলের কাছে বিল-সহ সমস্ত নথিপত্র যথাযথ ভাবে আলাদা করেও জমা দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

বিক্রেতা অনলাইনে আবেদন জানানোর পরেই ১৫ দিনের মধ্যে টাকা মেটানোর নির্দেশ দিয়ে ক্রেতার কাছে একটি ইমেল যাবে। সেই সময়সীমার মধ্যেই অনেকে সমস্যা মিটিয়ে নেয়। সে ক্ষেত্রে বিক্রেতা আবেদন প্রত্যাহার করে নেয়। আবেদন প্রত্যাহৃত না-হলে কাউন্সিল দু’পক্ষকে শুনানিতে ডাকে। প্রথম পর্যায়ের শুনানির সময়েই আবেদনকারীকে সমস্ত নথিপত্রের কপি জমা দিতে হয়।

বিচার ব্যবস্থা

আবেদন যথাযথ হলে প্রথম ধাপে আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করা হয়। দু’পক্ষকে ডেকে হয় সেই আলোচনা। বকেয়ার অঙ্ক নিয়ে দু’পক্ষ সহমত হয়ে তা মিটমাট করে নিতে পারে। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনে একাধিক বার আলোচনা করতে পারে কাউন্সিল।

দ্বিতীয় ধাপ হল শুনানি। বকেয়ার অঙ্ক বা অন্য কোনও বিষয় নিয়ে ক্রেতা সংস্থার আপত্তি থাকলে, তার স্বপক্ষে যুক্তি দিতে হবে তাকে। তবে এ ক্ষেত্রেও দু’পক্ষের মধ্যে বিতর্কের মিটমাট হতে পারে। তা না হলে সব দিক খতিয়ে দেখে রায় দেবে কাউন্সিল। যদি বিক্রেতার পাওনার দাবি ঠিক না-হয়, সে ক্ষেত্রে কাউন্সিল তা নির্দেশে জানাবে। আর যদি অভিযোগ ঠিক হয়, তা হলে তা সুদ সমেত ফেরত দেবে ক্রেতা।

সুদের হিসেব

ইনভয়েস ক্রেতাকে জমা দেওয়ার পর থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ক্রেতাকে দাম মেটাতে হয়। এ বার বকেয়া মেটানোর জন্য কমিটি নির্দেশ দিলে, ৪৫ দিনের সেই সময়সীমার শুরু থেকে নির্দেশ দেওয়ার দিন পর্যন্ত বকেয়ার অঙ্কের উপরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ‘ব্যাঙ্ক রেট’-এর তিন গুণ হিসেবে সুদ গুনতে হয় ক্রেতাকে। সেই সুদের হিসেবও কষা হয় মাসে চক্রবৃদ্ধি হারে।

টাকা না পেলে

কাউন্সিলের নির্দেশের পরেও যদি ক্রেতা বকেয়া না-মেটায়? রায়ের ৩০ দিনের মধ্যে টাকা না-মেটানো হলে বিক্রেতা আদালতে যেতে পারে।

সুযোগ ক্রেতাকেও

কাউন্সিলের রায় নিয়ে আপত্তি থাকলে ক্রেতার সামনেও আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকে। তবে কাউন্সিল যে অঙ্কের বকেয়া (সুদ-সহ) মেটানোর নির্দেশ দেবে, আদালতে তার ৭৫% জমা রেখে আবেদন করতে হবে।

উত্তরবঙ্গেও ভাবনা

এখন যে কোনও জেলার ছোট সংস্থাকেই কাউন্সিলের দ্বারস্থ হতে কলকাতায় আসতে হয়। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির জন্য কাউন্সিলের একটি পৃথক শাখা খোলার পরিকল্পনার কথা ইতিমধ্যেই জানিয়েছে রাজ্য।

প্রয়োজনীয় নথিপত্র

• অনলাইনে আবেদন জানানোর সময়েই বরাত ও ইনভয়েসের তথ্য দিতে হয়।

• আবেদনকারী সংস্থাকে জমা করতে হয় উদ্যোগ আধার মেমোরেন্ডাম (ইউএএম)।

• সংস্থাটি ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পেরই আওতাভুক্ত কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য ইউএএম যাচাই করবে জেলার শিল্প কেন্দ্র (ডিআইসি)।

• বিক্রেতা সংস্থাটি যে ব্যবসায়ী (ট্রেডার) বা মাঝারি শিল্পভুক্ত নয়, তা যাচাই করতে সংস্থাটির অডিট রিপোর্ট দরকার হতে পারে।

• জমা দিতে হবে সব বকেয়া বিলের প্রতিলিপি।

• হলফনামা ও বকেয়া বিল জমা দেওয়ার বয়ানের কাঠামো সংশ্লিষ্ট স‌ংস্থা কাউন্সিলের কাছ থেকেই পাবে।

• বকেয়া মেটানো নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনার আবেদন।

• পণ্য বা পরিষেবার মান ও কাজ ঠিক মতো যে হয়েছিল এবং ক্রেতা যে তার ভিত্তিতে সেটি গ্রহণ করেছিল, প্রয়োজনে তার নথিও।

• সব নথিপত্র ও বয়ান মিলিয়ে তিনটি সেট জমা দিতে হবে কাউন্সিলের কাছে।

• হলফনামার ক্ষেত্রে সেটির আসলের সঙ্গে দু’টি প্রতিলিপিও জমা করতে হবে।

• আবেদন, সংশ্লিষ্ট নথি ও হলফনামার প্রতিলিপির একটি সেট পাঠাতে হয় ক্রেতা সংস্থার কাছেও।

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে বড় ও মাঝারি শিল্পের পাশাপাশি, ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্প ক্ষেত্রের প্রসারেও জোর দিতে চাইছে সরকার। সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি যাতে ছোট সংস্থার কাছ থেকে পণ্য ও পরিষেবা কেনে, তার দিকেও জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিক্রির পরেও দাম হাতে পাওয়ার ক্ষেত্রে যদি সংস্থাগুলি সমস্যায় পড়ে, তা হলে তো আসল উদ্দেশ্যই ধাক্কা খায়। তার সমাধান সূত্র জানানো হল আজকের নিবন্ধে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Investment Plan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE