Advertisement
০৪ মে ২০২৪
এখনও জোটেনি শিল্পের তকমা

রাজ্যে পাটনীতি তৈরি নিয়ে অচলাবস্থা সেই তিমিরে

বছরে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার লেনদেন। তবুও পশ্চিমবঙ্গে এখনও শিল্পের মর্যাদা পায়নি পাট ব্যবসা। তৈরি হয়নি নিজস্ব পাটনীতি। ফলে অর্ধেকের বেশি চটকলই রুগ্ণ। ক্ষমতায় আসার আগে পাট শিল্পের হাল ফেরানো নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সরকারে তিন বছর কাটিয়ে দেওয়ার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। ফলে বাম আমলের ৩৪ বছরের মতো চটকল এখনও রয়ে গিয়েছে শ্রম দফতরের হাতে।

প্রভাত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৪ ০১:৪০
Share: Save:

বছরে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার লেনদেন। তবুও পশ্চিমবঙ্গে এখনও শিল্পের মর্যাদা পায়নি পাট ব্যবসা। তৈরি হয়নি নিজস্ব পাটনীতি। ফলে অর্ধেকের বেশি চটকলই রুগ্ণ।

ক্ষমতায় আসার আগে পাট শিল্পের হাল ফেরানো নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সরকারে তিন বছর কাটিয়ে দেওয়ার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। ফলে বাম আমলের ৩৪ বছরের মতো চটকল এখনও রয়ে গিয়েছে শ্রম দফতরের হাতে। এ ব্যাপারে এ বার সরব হয়েছে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনই। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এ নিয়ে বলেন, “সব দিক খতিয়ে দেখছি। পাটশিল্প বহু প্রাচীন। সমস্যাগুলিও খুব জটিল। জট ছাড়িয়ে পাকাপোক্ত নীতি তৈরি করতে তাই কিছুটা সময় লাগছে।”

মূলত পশ্চিমবঙ্গের পাটশিল্পকে বাঁচাতে দু’দশক আগে কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় পাটনীতি তৈরি করে। ২০০৫ সালে আরও একবার সংশোধিত জাতীয় নীতি তৈরি করে দিল্লি। এর পাশাপাশি যে-সব রাজ্যে চটকল রয়েছে, তাদের নিজস্ব নীতি তৈরির ব্যাপারে উৎসাহও দিয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু পাটশিল্প মূলত পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও এ রাজ্যে এখনও কোনও পাটনীতি তৈরি হয়নি। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মালিক, শ্রমিক ও পাটচাষিদের স্বার্থরক্ষা এবং রাজ্য সরকারের বৃহত্তর ভূমিকার জন্য রাজ্য স্তরে এই শিল্পের জন্য স্পষ্ট নীতি তৈরি হোক, চাইছেন সংশ্লিষ্ট সবপক্ষই।

রাজ্যের মোট ৫৪টি চটকলের মধ্যে ২৮টি অর্থাৎ প্রায় ৫২% নিজেদের রুগ্ণ ঘোষণা করে শিল্প ও আর্থিক পুনর্গঠন পর্ষদ বা বোর্ড ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল রিকনস্ট্রাকশন (বি আই এফ আর)-এর বিচারাধীন। একটি শিল্পে এতগুলি কারখানা রুগ্ণ। তবুও এ রাজ্যে চটকলগুলির মিলিত ব্যবসার পরিমাণ বছরে ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। অথচ এত টাকার ব্যবসায়ে আধুনিকীকরণ হয় না, নিজস্ব নীতিও নেই বলে অভিযোগ শ্রমিক মহলের।

এ নিয়ে চটকল মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে বাম আমলে বার বার মহাকরণে দরবার করা হয়। বলা হয়, ব্যবসার পরিমাণ দেখে শিল্প দফতর নতুন নীতি তৈরি করুক। কিন্তু লাভ হয়নি। চটকল মালিকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সঞ্জয় কাজারিয়া, বর্তমান চেয়ারম্যান রাঘবেন্দ্র গুপ্ত উভয়েই এক সুরে বলেন, “ব্যবসা চালাতে শিল্প দফতর যে-সব সুযোগ-সুবিধা দেয়, আমরা কখনও তা পাই না। কারণ আমাদের শিল্প হিসেবে গণ্য করাই হয় না।”

রাজ্যের শ্রম দফতরের দায়িত্ব মলয় ঘটকের হাতে যাওয়ার পরে তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনেও ক্ষমতায় রদবদল ঘটেছে। প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর আমলে আইএনটিটিইউসি-তে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় অনেকটা কোণঠাসা ছিলেন। সম্প্রতি শোভনদেববাবু নতুন করে তাঁর জুট ফেডারেশনের বড়সড় বৈঠক করেন। তিনি বলেন, “একের পর এক চটকল বন্ধ হওয়ায় আমরা চিন্তিত। আমাদের দাবি, রাজ্য স্পষ্ট পাটনীতি তৈরি করুক। শুধু শ্রম দফতরের হাতে সব ছেড়ে রাখলে চলবে না। মমতাকেও সব বলেছি।”

এ দিকে পাটশিল্পের হাল ফেরাতে উদ্যোগী বণিকসভাও। বেঙ্গল চেম্বারের ডিরেক্টর জেনারেল প্রিয়দর্শন রায় বলেন, “রাজ্যে পাট অন্যতম প্রধান শিল্প। তার উন্নয়নে কী কী করা যেতে পারে, প্রস্তাবের আকারে তা জানতে চেয়েছিল সরকার। শিল্পের অবস্থা, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সরকারকে জানিয়েছি। এখন সরকার তার সিদ্ধান্ত নেবে।” ক্যামাক স্ট্রিটে রাজ্য শিল্প দফতরের এক সূত্র অভিযোগ তোলেন, “মুশকিলটা হল, ২০১৩-র গোড়ার দিকে মুখ্যমন্ত্রী পাটনীতি তৈরির দায়িত্ব সঁপে দিয়েছিলেন ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প তথা বস্ত্র সচিব রাজীব সিংহের ওপর। ফলে কিছুই আর এগোয়নি।”

তবে প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ওই দফতর যাওয়ার সামান্য আগে তড়িঘড়ি করে তৈরি ৪ পৃষ্ঠার কিছু প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়েছিল শিল্প দফতর। সেটি বাতিল করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। নতুন শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রের আমলে কিছু জমা পড়েনি।

অমিতবাবু পাটশিল্পে যে-জটের কথা বলেছেন, তার অন্যতম উদাহরণ মালিকানা সমস্যা। রাজ্যে ৫৪টি চটকলের মধ্যে ১৮টির কোনও মালিকের হদিসই নেই। সেগুলি চলে কেন্দ্রের জুট প্যাকেজিং মেটেরিয়ালস (কম্পালসরি ইউজ ইন প্যাকিং কমোডিটিজ) আইন ১৯৮৭ (সংক্ষেপে জেপিএম) অনুসারে বস্ত্র মন্ত্রকের দেওয়া চটের বস্তার বরাতের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মালিকবিহীন চটকলগুলি চলছে কী করে? বেঙ্গল চেম্বারের মত, প্রতিটিই মালিকানা দ্বন্দ্বে হাইকোর্টের দ্বারস্থ। যেহেতু কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রকের বস্তার বরাত রয়েছে, তাই কারখানা চালু রাখার জন্য আদালতের রায়ে স্পেশাল অফিসার বসানো হয়েছে। অফিসারদের হয়ে কারখানা চালাচ্ছেন এক বা একাধিক কাঁচামাল সরবরাহকারী।

বণিকসভা জানিয়েছে, বহু প্রাচীন এই সব চটকলের আয়তন বিরাট। আধুনিকীকরণে প্রচুর টাকা খরচ হবে। এ ছাড়া, বিআইএফআরে যে-সব কারখানা রয়েছে, সেগুলিও কেন্দ্রের বরাত নিয়ে চলছে। সেখানেও আধুনিকীকরণ না-হওয়ায় শ্রমিকেরা বিপজ্জনক ভাবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর একটি সমস্যা, পাটশিল্পে একাধিক ইউনিয়নের দৌরাত্ম্য। ইউনিয়নগুলির অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপের জন্যই চলতি বছরেও কেন্দ্রের মোট বরাতের ৩০% চলে গিয়েছে প্লাস্টিক বস্তা নির্মাতাদের হাতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jute policy westbengal deadlock
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE