স্মৃতি: শুটিংয়ে ব্যস্ত মৃণাল সেন। ফাইল চিত্র
‘‘কলকাতা শহরে কত উনুন?’’ ছবির প্রধান চরিত্রের মনে এই প্রশ্ন উস্কে দিত মৃণাল সেনের ‘চালচিত্র’।
মধ্যবিত্ত সংসারে রান্নার গ্যাসের যুগ নয় সেটা। উনুনের ধোঁয়া, লোডশেডিংয়ের অন্ধকার ঘেরা বারো-ঘর-এক-উঠোন আর পাঁজরের হাড় বার করা সত্তর-আশির কলকাতা সবচেয়ে বেশি যাঁর ছবিতে ধরা দিয়েছে, তিনি মৃণাল সেন।
চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, বাংলার চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে কলকাতার সবচেয়ে নিবিড় এবং স্থায়ী প্রণয়ী মৃণাল সেন। যে প্রেম এসেছিল তাঁর মধ্যবিত্ত শ্রেণিগত অবস্থান থেকেই। লং শট-এ একটু লো অ্যাঙ্গলে কে কে মহাজনের ক্যামেরায় শহরের গলিঘুঁজি, ছাদ দেখলেই চেনা যায় মৃণালের স্বাক্ষর।
চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি বলছে, কী ভাবে উনি ফুটপাতে হাতে ‘ফ্রন্টিয়ার’ নিয়ে তর্ক করতে ভালবাসতেন। সেই ভালবাসাই তাঁকে কলকাতার গলি-উপগলি নিয়ে যত্নশীল করেছিল। সঞ্জয়ের মতে, ‘‘ষাটের দশকের গোড়াতেই ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিতে চিনা চরিত্রটি যখন সিনেমার পোস্টারে এক অ-বাক নারীর দিকে তাকায়, বোঝা যায়, মৃণাল সেন কলকাতার এক অন্য রূপকল্প ভাবছেন। সেই রূপকল্পই আরও গভীর হয় সত্তরের দশকে।’’ কোরাস বা কলকাতা’৭১-এর যে কলকাতা, সেটা পরিচালকের নিজের ভাষায়, ‘ইনটেস্টিন্স অব দ্য সিটি’। শহরের অন্তঃপ্রণালী। ‘ভুবন সোম’, যেখানে শহর নেই, সেখানেও মৃণাল গ্রামকে পরীক্ষা করেন শহরের চোখ দিয়েই।
আরও পড়ুন: মানিকদার চোখে থেকে গিয়েছিল মুগ্ধতার রেশ
মৃণালের অন্যতম প্রিয় অভিনেতা ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ও পরিচালকের কলকাতা-প্রেমের ঘনিষ্ঠ সাক্ষী। বলছিলেন, ‘‘ছাত্রজীবন, আইপিটিএ-র সঙ্গে যোগ এবং পরে কিছুদিন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি— জীবনের বিভিন্ন স্তরে কলকাতাকে চষে খেয়েছেন মৃণালদা।’’ শহরের যে ছবিটা ওঁর মগজে রয়েছে, সেটা বুঝে নেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ধৃতিমানের কথায়, ‘‘পদাতিক’-এর সময়ে ক্যামাক স্ট্রিটের একটি বহুতলে শুটিং হত। কাজ শেষে সেখানেই আমরা থাকতাম। যাতে যে কোনও সময়ে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।’’ কলকাতা’৭১-এর জন্য ভবানীপুর, কালীঘাট আদিগঙ্গার ধার থেকে একেবারে ময়দান পর্যন্ত ক্যামেরা ধাওয়া করত অভিনেতা দেবরাজ রায়কে। এ দিন সে কথা মনে করে তিনি বলছিলেন, ‘‘প্রচুর দৌড় করিয়েছিলেন মৃণালদা!’’
সঞ্জয় মনে করিয়ে দেন, সত্যজিৎ বা ঋত্বিকের সঙ্গে মৃণালের প্রধান তফাৎই হল রোজকার জীবনের গল্প বলায়। মৃণাল প্রায়ই তাঁর প্রিয় চিত্রনাট্যকার, ইটালির জাভাতিনিকে উদ্ধৃত করে বলতেন, ‘টুডে টুডে অ্যান্ড টুডে’। সেই আজ-এর গল্পে কলকাতাই ছিল তাঁর নায়িকা। সঞ্জয়ের কথায় তাই, ‘‘মৃণাল চলে যাওয়াতে কলকাতার অধরোষ্ঠে কিছু চাপা কান্না থেকে যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy