বছরের শেষ দিনে আলোয় সাজানো পার্ক স্ট্রিটে উৎসাহী জনতার ভিড়।
কলকাতা হাইকোর্ট বলেছিল, শহরের কোথাও যাতে ভিড় না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে পুলিশ-প্রশাসনকে। পুলিশ-প্রশাসন জানিয়েছিল, আদালতের নির্দেশ মেনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হবে সর্বত্র। বৃহস্পতিবার বছরের শেষ দিনে উৎসবমুখী শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে ঘুরে দেখা গেল, পুলিশ-প্রশাসন কিছু ব্যবস্থা রেখেছে ঠিকই। কিন্তু তাতে ভিড়ে লাগাম টানা গেল কই? দূরত্ব-বিধি পালন বা মাস্কের ব্যবহারই বা নিশ্চিত করা গেল কোথায়? সর্বত্রই তো চলল বেপরোয়া উদ্যাপন। উৎসবমুখী এক যুগল আবার বলে দিলেন, “করোনার নিয়ম নতুন বছরে মানব, শপথ নিয়েছি। আজ কিছু মানা যাবে না। আজ শুধুই পার্টি!”
উৎসবমুখী জনতার এ দিনের এই বেপরোয়া ভাব টেক্কা দিল বড়দিনের ভিড়কেও। পুলিশেরই হিসেব বলছে, শুধুমাত্র পার্ক স্ট্রিট আর চিড়িয়াখানায় বড়দিনে দুপুর ২টো পর্যন্ত যেখানে ৮০ হাজার লোক হয়েছিল, সেখানে বছরের শেষ দিনে দুপুর ২টোর মধ্যে সেই সংখ্যা আড়াই লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। একই ভাবে তিন-চার গুণ বেশি ভিড় হয়েছিল ধর্মতলা, ময়দান, ভিক্টোরিয়া ও নিউ টাউনের বিভিন্ন বিনোদন পার্কে। রাত বাড়তেই সেই ভিড় সরে এসেছে বিভিন্ন পানশালা ও রেস্তরাঁ চত্বরে।
সন্ধ্যায় ভিড়ে ঠাসা পার্ক স্ট্রিটের একটি রেস্তরাঁর সামনের ফুটপাতে বসে পড়েছিল আট-ন’জন তরুণ-তরুণীর একটি দল। কারও মুখেই মাস্ক নেই। মাটিতেই শুরু হল কেক কেটে ওই দলের এক জনের জন্মদিন পালন। ভিড়ে রাস্তা আটকে গিয়েছে কি না, দেখতে আসা এক পুলিশকর্মী রেগে আগুন কারও মুখে মাস্ক নেই দেখে। ওই দলেরই এক জন তাঁকে বললেন, “রেস্তরাঁয় ঢুকে দেখুন, কেউ মাস্ক পরে আছে কি না! মাস্ক পরে খাওয়া যায় না। আমরা ফুটপাতে কেক খাব, তাই মাস্ক পরব না।” খানিক কথা কাটাকাটির পরে পুলিশকে হাল ছাড়তেই হল। রেস্তরাঁয় লাইন দেওয়া চার-পাঁচ জন বললেন, “বাচ্চারা কেক খাচ্ছে, ছাড়ুন না। একটু তো আনন্দ করবে! আমরাও তো শুধু রেস্তরাঁয় ঢুকব বলে মাস্ক পরে আছি। মাস্ক না পরলে ঢুকতে দেবে না। উৎসবের রাতে মাস্ক এখন শুধুই গেট পাস!”
আরও খবর: ২০২২-এর মার্চেই কোভিডের আগের অবস্থায় ফিরবে অর্থনীতি: নীতি আয়োগ
আরও খবর: বঙ্গ বিজেপির আড়ালের সেনাপতি শিবপ্রকাশের দায়িত্ব বাড়ল ভোটের মুখে
চিড়িয়াখানার সামনে ১৬ জনের একটি পরিবারের সকলেই রাস্তায় মাস্ক খুলে দাঁড়ালেন ছবি তুলতে। এক জন হাসতে হাসতে বললেন, “তাড়াতাড়ি কর ভাই, নইলে কাল মাস্ক পরিনি বলে কাগজে ছবি উঠে যাবে।” যাঁর দিকে তাকিয়ে বলা, তিনি নিজস্বী তুলতে তুলতেই স্বগতোক্তি করলেন, “পুজোর শপিং, ঠাকুর দেখা থেকে বড়দিনে ঘোরা! কিছুতেই তো করোনা হল না। বছরের শেষ দিনে নাকি করোনা ধরবে!” পাশ দিয়ে হাঁটা এক বৃদ্ধা অবশ্য ওই পরিবারের বেপরোয়া ছবি তোলার দৃশ্য দেখেই খানিক সরে দাঁড়ালেন। সত্তরোর্ধ্ব স্বামীকে বললেন, “দেখেছ অবস্থা! মাস্কটা ভাল করে টেনে নাও।”
করোনায় বয়স্কদেরই তো বেশি ভয়। তার মধ্যে বেরিয়েছেন? বৃদ্ধা বললেন, “দুই ছেলে বিদেশে থাকে। এখানে আমরা বুড়ো-বুড়ি। আজ আসলে আমাদের বিবাহবার্ষিকী। তাই বেরিয়ে পড়েছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বড় ভুল হয়েছে। দেখছি, বেশির ভাগেরই মাস্ক ব্যাগে ভরা। কত জনকে যে বলতে শুনলাম, মাস্ক পরলে সাজ নষ্ট হয়ে যাবে! বলি, জীবন আগে না সাজ?”
রাত ১২টা নাগাদ পার্ক স্ট্রিট মোড়ে কর্তব্যরত এক পুলিশকর্মী আবার বললেন, “আমার আবার অন্য প্রশ্ন। জীবন আগে না কাজ? কার্ফু জারি না করলে মানুষ বেরোবেই। কত জনকে বোঝাব ভিড়ের মধ্যে ঢুকে? পুলিশের নিরাপত্তা কে দেখবে? মাস্ক না পরার কত যে অছিলা।” পাশে দাঁড়ানো আর এক পুলিশকর্মীর মন্তব্য, “ওয়াচটাওয়ারের ডিউটি নেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি চলছিল গত দু’দিন। ওখানে এক বার উঠতে পারলে ভিড়ে ঢুকতে হয় না। আমরা যাঁরা ওই ডিউটি পাইনি, তাঁরা দূর থেকে কিছু লোককে মাস্ক বিলি করে, মোবাইলে ছবি তুলে রেখেই দায়িত্ব পালন করছি।”
পুলিশের কথা শেষ না হতেই রাস্তা পার করানোর জন্য রাখা দড়ির সামনে কলেজপড়ুয়া একদল তরুণ-তরুণী চেঁচাতে শুরু করলেন, “মাস্ক খুললে কি দড়ি উঠবে? এই তো ২০২১, কারও মুখেই মাস্ক নেই দেখ!” পুলিশকর্মীর মন্তব্য, “এ ভাবে বর্ষবরণ? কাকে কী বোঝাবেন?”
রাত ১২টা থেকেই তপসিয়ার এক রেস্তরাঁর গাড়ি রাখার জায়গায় হাতজোড় করে দাঁড় করানো হয়েছিল এক কর্মীকে। মত্ত অবস্থায় গাড়ি না চালাতে বলার পাশাপাশি নিজস্ব গাড়িতেও মাস্ক পরার কথা বলেছেন তিনি। রাত দেড়টা নাগাদ সেখান থেকে বেরোনোর পথে তাঁকে শুভ নববর্ষ জানিয়ে এক ব্যক্তি বললেন, “এ সবের দরকার নেই। বছরের শেষ দিন পর্যন্তও যখন করোনা হয়নি, আর হবেও না। শেষ ভাল যার, সব ভাল তাঁর।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy