Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ শহর জানে না আজাদের ঠিকানা

গাড়ি বারান্দার উপরের খোলা জায়গা থেকে হাত নাড়তেন তিনি। ছিপছিপে চেহারায় রোদচশমা চোখে, কালো টুপি আর ধোপদুরস্ত পোশাক পরা মানুষটির বড্ড প্রিয় ছিল ওই খোলা বারান্দাটা। সেখানে বসে লেখালেখিও করতেন।

স্মৃতি: শহরে মৌলানা আজাদের শেষ ঠিকানা। নিজস্ব চিত্র

স্মৃতি: শহরে মৌলানা আজাদের শেষ ঠিকানা। নিজস্ব চিত্র

জয়তী রাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:০৭
Share: Save:

গাড়ি বারান্দার উপরের খোলা জায়গা থেকে হাত নাড়তেন তিনি। ছিপছিপে চেহারায় রোদচশমা চোখে, কালো টুপি আর ধোপদুরস্ত পোশাক পরা মানুষটির বড্ড প্রিয় ছিল ওই খোলা বারান্দাটা। সেখানে বসে লেখালেখিও করতেন। ব্রিটিশের ঘাম ছোটানো সর্বভারতীয় এই কংগ্রেসি নেতা, তাঁর ৪৪ বছর বয়সে যখন বালিগঞ্জের লাভলক প্লেসের বাড়িটিতে থাকতে শুরু করেন, তখনও স্বাধীনতা আসতে ১৫ বছর বাকি।

সেই বাড়ির বর্তমান ঠিকানা ৫, আশরাফ মিস্ত্রি লেন। তবে তারও বহু আগে থেকে এ শহরের সঙ্গে ফিরোজ বখত তথা মহিউদ্দিন আহমেদের যোগ। মানুষটি অবশ্য মৌলানা আবুল কালাম আজাদ নামেই পরিচিত ছিলেন। ১৮৮৮ সালে মক্কায় জন্মের কয়েক বছর পরে বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতার নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন আমলাতলা লেনে চলে আসেন। বাবা মৌলানা খইরুদ্দিন ছিলেন পণ্ডিত।

লাভলক প্লেসের আগে রিপন লেন, স্টোর রোড এবং তারও আগে ম্যাকলয়েড স্ট্রিটে মৌলানা আজাদ থাকতেন বলে শোনা যায়। যদিও সে সবের সমর্থনে জোরালো তথ্য নেই। শোনা যায়, ১৩ জুলাই ১৯১২ সালে ১৩, ম্যাকলয়েড স্ট্রিটের ঠিকানা থেকেই উর্দু সাপ্তাহিক আল-হিলাল প্রকাশ হয়। সাপ্তাহিক ওই পত্রিকায় নিয়মিত ব্রিটিশদের নিয়ে সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশিত হওয়ার কারণে ১৯১৪ সালে নিষিদ্ধ হয়। পরের বছর নভেম্বরে একই ঠিকানা থেকে প্রকাশ হয় আল-বালাঘ। ৩১ মার্চ ১৯১৬ পর্যন্ত তা ছাপা হয়েছিল। ফের তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তাঁকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেই ধ্বংসস্তূপে এখন চলে লোহালক্করের কারবার। গাড়ির নম্বর প্লেট তৈরির ব্যবসা চলে সেখানে।

একমাত্র এ শহরের শেষ ঠিকানা আশরাফ মিস্ত্রি লেনের বাড়িতে তৈরি হয়েছে তাঁর নামাঙ্কিত সংগ্রহশালা। সেটি দেখাশোনা করে ‘মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ’। আজাদের জন্ম শতবর্ষের বেশ কয়েক বছর পরে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে বাড়িটিকে সংগ্রহশালা করা হয়। তাঁর ব্যবহৃত লাঠি, চশমা, টুপি, রকমারি ছাইদান, চিনের গ্রিন টি-র বাক্স, তাঁর স্বাক্ষরিত চিনামাটির খাবারের পাত্র, সৌদির রাজার উপহার দেওয়া ঢোলা জোব্বা, একাধিক শৌখিন আসবাব সাজানো সেখানে। ১৯২৩ সালে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেসের সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি হন ৩৫ বছরের মৌলানা। রয়েছে সেই ব্যাজ এবং মরণোত্তর ভারতরত্নের পদক। সংগ্রহশালার কিউরেটর স্বরূপ ভট্টাচার্য বলেন, “ওঁর পরিবারের থেকে পাওয়া বাসন-সহ বিভিন্ন জিনিসও রয়েছে। সে সব দিয়ে সংগ্রহশালা আরও সাজানো হবে।”

তথ্য বলছে, ১৯৩২-৪৭ সাল পর্যন্ত এখানে সস্ত্রীক থাকতেন মৌলানা। বেলেঘাটার জমিদার নস্করদের সম্পত্তি ছিল এই বাড়ি। বিধানচন্দ্র রায় স্বাধীনতা সংগ্রামী হেম নস্করের কাছে মৌলানা আজাদের থাকার জন্য বাড়িটি চেয়ে বসেন। হেম নস্করের নাতি এবং প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী অর্ধেন্দু নস্করের ছেলে অশোক নস্কর বলেন, “ঊনবিংশ শতকের আশির দশকে এই বাগানবাড়ি তৈরি করেছিলেন রামকৃষ্ণ নস্কর। তখন জলজঙ্গলে ভরা ছিল এই অঞ্চল। পরবর্তীকালে তাঁর ভাই, জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য তারণকৃষ্ণ নস্করের উদ্যোগে বাংলার বাইরে থেকে আসা জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা সেখানে থাকতেন।”

ঐতিহাসিক বাড়ির আরও এক সাক্ষী ৯৮ বছরের আরতি মুখোপাধ্যায়। এক নম্বর, লাভলক প্লেসে জন্ম থেকে আছেন। প্রাক্তন শিক্ষিকা আরতিদেবী যাতায়াতের পথে দেখেছেন, প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আছেন জে বি কৃপালনি। এখনও মনে পড়ে, বাড়ির বাইরে জনসমাগম দেখলে দোতলার বারান্দা থেকে হাত নাড়তেন মৌলানা। বিভিন্ন বৈঠকে এ বাড়িতে এসেছেন জওহরলাল নেহরুও। পাশে বসা মেয়ে প্রমিতা সেন মনে করিয়ে দেন, ওই বাড়িতে তাঁর মা দেখেছিলেন মহাত্মা গাঁধী, সর্দার বল্লভ ভাই পটেলকেও।

স্ত্রী জুলেখা বেগমের মৃত্যুর পরে আরও বছর পাঁচেক ওই বাড়িতেই ছিলেন মৌলানা। তাঁর শৌখিনতা

আর নেতৃত্বের বহু স্মৃতি আঁকড়ে থাকলেও আজও কিছুটা অন্তরালে বাড়িটি। শহরের বহু মানুষই এর হদিশ জানেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE