অবরোধ: রাস্তা আটকে বসে আছেন অভিভাবকেরা। মঙ্গলবার, রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক রোডে। —নিজস্ব চিত্র।
স্কুলের জারি করা একটি বিজ্ঞপ্তি। যা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল কিছু বিভ্রান্তি। সেই বিভ্রান্তি কাটাতে প্রধান শিক্ষক বা স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি বার কথা বলার আগেই ক্ষুব্ধ অভিভাবকেরা বেছে নিলেন এ শহরে বিক্ষোভ দেখানোর সহজতম পন্থাটি— রাস্তা অবরোধ। হইহই করে পথে নেমে তাঁরা আটকে দিলেন সমস্ত যানবাহন। মঙ্গলবার সকালে এ ভাবেই একটি স্কুলের অভ্যন্তরীণ সমস্যার জেরে নাস্তানাবুদ হলেন কর্মস্থলমুখী হাজার হাজার মানুষ।
এ দিন সকালে এই ঘটনা ঘটে যাদবপুর বিদ্যাপীঠ স্কুলের সামনে। সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত টানা দেড় ঘণ্টা রাস্তা আটকে রাখেন ওই স্কুলের প্রাথমিক পড়ুয়াদের অভিভাবকদের একটা বড় অংশ। পরিস্থিতি এক সময়ে এমনই দাঁড়ায় যে, বন্ধই করে দিতে হয় স্কুল। এই গোটা ঘটনায় কোনও ষড়যন্ত্র বা কারও হাত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা স্কুল কর্তৃপক্ষের।
গত শুক্রবার স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তির একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সেখানে লটারিতে ভর্তির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া ছিল। পাশাপাশি বলা হয়েছিল, ২০১১ সালে রাজ্য সরকার যে নিয়ম চালু করেছে, সে ভাবেই ভর্তি নেওয়া হবে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরিমল ভট্টাচার্য জানান, ওই নিয়ম অনুযায়ী পঞ্চম শ্রেণিতে লটারির মাধ্যমে ভর্তি নেওয়া হয়। কিন্তু যে সমস্ত স্কুলে এক ছাদের তলায় প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত রয়েছে, সেখানে লটারির বদলে পড়ুয়ারা সরাসরি পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারে। এ ভাবেই কয়েক বছর ধরে স্কুলে ভর্তি-প্রক্রিয়া চলছে। তার পরে গত শনিবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, আগামী বৃহস্পতিবার চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়াদের অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধান শিক্ষক।
এখানেই বিভ্রান্তি ছড়ায় অভিভাবকদের মধ্যে। ওই বিজ্ঞপ্তি পড়ে তাঁদের মনে হয়, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই লটারির মাধ্যমে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হতে হবে। অনেকে ভাবতে শুরু করেন, পুরনো নিয়ম বাতিল করে নতুন নিয়ম চালু হচ্ছে। আর এক দল অভিভাবকের ধারণা হয়, তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ রীতিমতো সঙ্কটে। তার জেরেই এ দিন তুমুল গোলমাল হয় স্কুল চত্বরে। টানা দেড় ঘণ্টা রাস্তা অবরোধের জেরে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড থেকে ঢাকুরিয়া পর্যন্ত অংশে ট্র্যাফিক ব্যবস্থা কার্যত তালগোল পাকিয়ে যায়। রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন থেকে আসার অটোভাড়া ১৩ টাকার বদলে হয়ে যায় ২০ টাকা! স্কুলের ভিতরে আটকে পড়ে খুদে পড়ুয়ারা। অবশেষে কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে অবরোধ ওঠে। অভিভাবকদের এই আচরণে প্রবল বিরক্তি প্রকাশ করেন যানজটে আটকে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা সাধারণ মানুষ।
বিজ্ঞপ্তির ভাষা স্পষ্ট ভাবে বুঝতে না পারার ফলেই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে বলে দাবি স্কুল কর্তৃপক্ষের। স্বরূপ ঘোষ নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘‘প্রাথমিকে লটারির মাধ্যমে ভর্তি নেওয়া হয়। কিন্তু তার পরে লটারির কোনও নিয়ম নেই। অথচ, এ বছর নতুন নিয়ম চালু হচ্ছে। এটা মানা হবে না।’’ অন্য এক অভিভাবক রূপা সরকার বলেন, ‘‘বিজ্ঞপ্তির কিছুই বোঝা যায়নি। প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষিকা জানিয়েছেন, এ বছর চতুর্থ থেকে পঞ্চমে সকলে সরাসরি ভর্তি হবে। পরের বছর থেকে কী হবে, জানি না।’’
কিন্তু পথ অবরোধ না করে স্কুলের সঙ্গে কথা বললেই তো পরিষ্কার হওয়া যেত? রূপাদেবী ও স্বরূপবাবুর যুক্তি, ‘‘যখন অবরোধ শুরু করলাম, তখন তো প্রধান শিক্ষক স্কুলে আসেননি।’’ পরে পুলিশের মোটরবাইকে চেপে প্রধান শিক্ষক স্কুলে পৌঁছে ঘোষণা করেন, যারা ওই স্কুলের প্রাথমিক বিভাগে পড়ছে, তারা চাইলেই সরাসরি পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে। নিয়মের কোনও পরিবর্তন হয়নি। তার পরে অবরোধ ওঠে। কিন্তু তত ক্ষণে প্রাথমিকের পড়ুয়াদের অনেকেই আতঙ্কে কান্নাকাটি করতে করতে ক্লাসের ভিতরে ঝিমিয়ে পড়েছে। কারণ, সকাল ১০টায় ছুটি হলেও গোলমালের জন্য বহুক্ষণ তারা বেরোতে পারেনি। অন্য দিকে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পড়ুয়ারা ঢুকতে না পারায় ক্লাস ছুটি দিয়ে দিতে হয়।
অভিভাবকদের এই আচরণে তাজ্জব সাধারণ মানুষ। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, স্কুলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে পথ অবরোধ করা হবে কেন? এত মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলার অধিকারই বা ওই সমস্ত অভিভাবককে কে দিল? এক যুবক তাঁর অসুস্থ মাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার পথে যানজটে আটকে পড়েন। তখন তাঁর সঙ্গে অভিভাবকদের কথা কাটাকাটিও হয়। ওই যুবকের প্রশ্ন, পুলিশ কেন অবরোধকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিল না? ঘটনাস্থলে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে পুলিশকর্তারা কিছু বলতে চাননি।
স্কুলের দুই বিভাগের মধ্যে যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, পরিমলবাবুর কথাতেই তা স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘‘প্রাথমিক বিভাগটি বেসরকারি। কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয়নি যে, কত জন পড়ুয়া রয়েছে। এ ছাড়া, সকাল সাতটা থেকে জমায়েত হলেও ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এক বারও আমাকে সেটা জানাননি।’’ প্রাথমিক বিভাগের প্রধান শিক্ষিকা রূপশ্রী সাহা বলেন, ‘‘পরিমলবাবুকে ফোন করেছিলাম। ব্যস্ত পেয়েছি।
তা ছাড়া, অভিভাবকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। কেউ কোনও কথাই শুনতে চাননি।’’ অবরোধকারী অভিভাবকদের সাফ যুক্তি, ‘‘এটা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের বিষয়। তাই পথ অবরোধ করতে বাধ্য হয়েছিলাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy