Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘দোষ কি আমাদের একেবারেই ছিল না?’

এই সময়টাতেই নেশায় ডুবে যেতে শুরু করে ও। নাইটক্লাবে যাতায়াত শুরু করে। নাবালক বলে সেখানে প্রথম দিকে ঢুকতে দেওয়া হত না।

নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর বাজেয়াপ্ত করা মাদক। নিজস্ব চিত্র

নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর বাজেয়াপ্ত করা মাদক। নিজস্ব চিত্র

শান্তনু বসু (নাম পরিবর্তিত, অভিজিতের বাবা)
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৪৫
Share: Save:

ছেলের দেখভালে যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে, তার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি আমি আর ওর মা। সেই ছেলে বড় হয়ে এ ভাবে মাদকাসক্ত হয়ে যাবে, তা কল্পনাও করিনি। তবে এখন মনে হয়, দোষ কি আমাদের একেবারে ছিল না!

ওর স্কুলে যাতায়াতে কোনও সমস্যা যাতে না হয়, তাই স্কুলবাসের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরে নতুন স্কুল থেকে অভিযোগ আসে, ছেলে স্কুলে যাচ্ছে না। তখন ওকে চেপে ধরি। জানতে পারি, স্কুলের সামনে বাস থেকে নেমে অন্যত্র চলে যেত ও। আবার ছুটির সময়ে স্কুলের সামনে গিয়ে বাসে উঠে পড়ত। কিন্তু কোথায় যেত, তা বুঝি আর একটু বেশি ভাল ভাবে খোঁজ করা উচিত ছিল।

এই সময়টাতেই নেশায় ডুবে যেতে শুরু করে ও। নাইটক্লাবে যাতায়াত শুরু করে। নাবালক বলে সেখানে প্রথম দিকে ঢুকতে দেওয়া হত না। কিছু দিনের মধ্যেই আধার কার্ডে জন্মের তারিখ বদলে, বেআইনি ভাবে নিজেকে সাবালক প্রমাণ করে নাইটক্লাবে ঢোকার ব্যবস্থাও করেছিল বলে পরে জেনেছি।

সন্তানের খেয়াল রাখুন

• ছেলে-মেয়ে ঘন ঘন বেশি টাকা চাইছে কি না
• মিথ্যে কিংবা অসংলগ্ন কথা বলার প্রবণতা দেখছেন কি
• ‘বন্ধুদের’ নাম, তথ্য গোপন করছে না তো
• বেশি দেরি করে ফিরলে কারণ জানা জরুরি
• মাঝেমধ্যেই বমি বা মাথাধরার সমস্যা হলেও সাবধান

এর পরেই বিষয়টা একটু একটু করে জানতে পারি। কয়েক বার হয়েছে, ফিরছে না দেখে নাইটক্লাব বা বন্ধুর বাড়িতে খোঁজ করতে গিয়ে দেখেছি, নেশায় চুর হয়ে আছে ছেলে। আমাকে ধাক্কা পর্যন্ত মেরেছে। কখনও এমন হয়েছে, বন্ধুর সঙ্গে বিদেশি গাড়ি চালিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছে। দু’জনেই নেশাতুর। আমি ওর বন্ধুর গাড়ি আমার গ্যারাজে ঢুকিয়ে রেখেছি। এক বার ওর বন্ধুর বাড়ির সামনে রেল কলোনির ছেলেদের সঙ্গে নেশা করা নিয়ে মারপিটে জড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি থানা পর্যন্ত গড়ায়। আমার পুলিশে কিছু বন্ধু রয়েছেন। শেষে তাঁদের সাহায্য নিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে।

বিষয়টা যখন বুঝতে পেরেছি, তখন ও অনেক দূর চলে গিয়েছে। কী ভাবেই বা ধরতাম আগে?

ছোটখাটো চুরি হচ্ছিল আমাদের বাড়িতে। আমাদেরই ভুল, তখন বুঝতেই পারিনি, এটা যে ও করতে পারে। কী করে ভাবব আমার ক্রেডিট কার্ড থেকে চুরি হওয়া টাকা আসলে নিজের ছেলেই নিয়েছে! তেমনও ঘটেছে আমাদের বাড়িতে। আমার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে নিজের পেটিএমে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছিল। আমি তখন ঘুমোচ্ছিলাম। সেই সুযোগে আমার ক্রেডিট কার্ড, আমার মোবাইল নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে টাকা ট্রান্সফার করে নেয়। অথচ টাকা-পয়সার অভাব কখনও দেখেনি আমার সন্তানেরা।

তাঁরা বলছেন

রীতা চট্টোপাধ্যায়, এপিজে স্কুলের প্রিন্সিপাল
কিশোর-কিশোরীদের নেশা থেকে বার করতে অভিভাবকের সদর্থক ভূমিকা খুব জরুরি। অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মায়ের স্বপ্ন সন্তানের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা যেমন চান, ছেলেমেয়েও তেমনটাই হওয়ার জন্য ছুটছে। সেই স্বপ্নভঙ্গ হলে পুরো দায় পড়ছে সন্তানের উপরে। তার গায়ে বিফল হওয়ার স্ট্যাম্প পড়ে যাচ্ছে। যার ফলে অনেক সন্তান মুক্তির খোঁজে নেশার ফাঁদে পড়ছে।

জয়রঞ্জন রাম, মনোরোগ চিকিৎসক
স্কুল স্তরেই নেশার খারাপ দিকগুলি সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করে দেওয়া জরুরি। কারণ, কিশোর বয়সে মাদকে আকৃষ্ট হওয়ার ঘটনা বেড়েছে। তাদের মধ্যে কারা মাদকের নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে এবং কারা পারবে না, আগে থেকে এটা নির্ধারণ করা মুশকিল। তাই ঝুঁকি না নিয়ে আগে থেকে সতর্ক করে দেওয়া ভাল। তবে বাবা-মায়ের নজরদারি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

অভিজিৎ গুপ্ত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক
এখন তো ভেষজ, রাসায়নিক— অনেক ধরনের মাদক পাওয়া যায়। শুনেছি, সে সব বেশ সহজলভ্যও। বাজার থেকে মাদকের এই জোগান বন্ধ করা সবচেয়ে জরুরি। আমাদের এখানে তুলনায় কম সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর মধ্যেই এই সমস্যা দেখা গিয়েছে। তবে মাদকাসক্তদের নেশার ফাঁস থেকে বার করে আনতে বন্ধুদের ভূমিকা সদর্থক হওয়া উচিত।

দিলীপ শ্রীবাস্তব, নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর প্রাক্তন আঞ্চলিক অধিকর্তা
স্কুলগুলিতে সচেতনতা শিবির করা হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে পারলে বাজারেও মাদকের চাহিদা কমবে। উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্তেরা মূলত ব্রাউন সুগার, এলএসডি, কোকেন, এমডিএমএ-র মতো দামি মাদক ব্যবহার করে। নিম্নবিত্তদের মধ্যে গাঁজা ও সস্তার হেরোইনের চল বেশি। বিক্রেতাদের নিয়মিত ধরপাকড় প্রয়োজন। ধৃতদের দীর্ঘ দিনের সাজা হলে বাকিরাও সতর্ক হবে।

মধুরিমা ঘোষ, মনোরোগ চিকিৎসক
নেশা করলে মস্তিষ্কে যে ক্ষরণ হয়, তাকে ‘হ্যাপি হরমোন’ বলে। এতে একটা ভাললাগা তৈরি হয়। নেশা ছাড়াতে সেই ভাললাগা তৈরির অন্য মাধ্যম জরুরি। বই পড়া, খেলা, গান এ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। তরুণদের উপরে বন্ধুবান্ধবের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার চাপ থাকে। তা সহ্য করতে না পেরেও অনেকে নেশা করে। প্রতিটি ক্ষেত্রে কারণ যেমন আলাদা, সমাধানও আলাদা।

ছেলে হওয়ার পরে অনেকে বলেছিলেন, সংসারে একমাত্র সন্তান একাকিত্বে ভোগে। তাই পরিকল্পনা করেই আমরা দ্বিতীয় সন্তান নিই। ফলে একাকিত্বের জন্য নেশায় ডুবে গিয়েছে ছেলে, এ কথা মানতে ইচ্ছে করে না। তা ছাড়া, আমাদের যৌথ পরিবার। বাড়িতে অনেকে আছেন। দাদু-ঠাকুরমার অত্যধিক স্নেহের জন্যই কি তবে আমার ছেলে বিগড়ে গিয়েছে? জানি না। এখনও উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি।

কলকাতার একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ত ও। নবম শ্রেণি থেকে ও এমন কিছু ছেলের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে, যা আমার পছন্দ ছিল না। কিন্তু ছেলে সেই আপত্তি শোনেনি। ওদের সঙ্গে মিশে কী সব ইভেন্টের টিকিট বিক্রি করতে শুরু করে। সেখান থেকেও টাকা রোজগার করত। বন্ধুর জন্মদিনে গিয়ে এ শহরেরই এক কিশোরের মৃত্যু হয়। সেই ঘটনা নিশ্চই অনেকেরই মনে আছে। সেই সময়ে ওই কিশোরের সঙ্গে আরও যাদের নাম উঠে এসেছিল, তাদের মধ্যে দু’-এক জন আমার ছেলের বন্ধু ছিল। ওদের সঙ্গে মেলামেশার পরেই একটা ‘কেয়ার করি না’ ভাব ফুটে উঠছিল আমার ছেলের মধ্যেও।

ও যে ওই সময় মাদকের নেশা করছে, তা আমরা একেবারেই বুঝতে পারিনি। বাড়িতে যখন ফিরত, তখন কোনও অস্বাভাবিকতা দেখতাম না ওর হাবভাবে। মুখ থেকে কোনও গন্ধও পেতাম না। দেরি করে ফিরলে কারণ জানতে চাইতাম। উত্তর পেতাম, গল্ফ খেলছিল কিংবা বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। ওর আইসিএসই পরীক্ষার ফল ভাল হয়নি।

ছেলে এখন নেশামুক্তি কেন্দ্রে। এ বার বাড়ি ফিরে সুস্থ জীবন কাটাক, এ ছাড়া আর কিছুই চাই না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Drug Addiction
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE