ঘোষণার পর হুড়োহুড়ি। —ফাইল ছবি
বেলা সাড়ে দশটায় ট্রেন আসার কথা বলে শোনা গিয়েছিল। এগারোটা পেরোলেও দেখা নেই। কয়েক বার খোঁজ খবর করেও ঠিক জানা গেল না, কোন প্ল্যাটফর্মে ঢুকবে সেই ট্রেন। অতএব, স্টেশনের বিভিন্ন কোণে একই ট্রেনের জন্য জটলা বাড়তে থাকল। অবশেষে বহু প্রতীক্ষার পরে হঠাৎ কোনও একটি প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢোকার ঘোষণা। ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি শুরু হল সেই প্ল্যাটফর্মে পৌঁছনোর জন্য। যার জেরে কেউ মাটিতে পড়লেন, কারও ব্যাগ ছিঁড়ল, কারও বা হাত কাটল ওভারব্রিজের ভাঙা রেলিংয়ে। কেউ ট্রেনে উঠলেন, অনেকেই পারলেন না। ডিসপ্লে তখনও বোর্ড অন্ধকার। জানা নেই পরের ট্রেন আবার কখন!
বালিগঞ্জ থেকে বিধাননগর, সোনারপুর থেকে সাঁতরাগাছি— সর্বত্র প্রবল ভিড়ের মধ্যে উদ্বিগ্ন মুখে ট্রেনের খবর জানার জন্য যাত্রীদের প্রতীক্ষার ছবিটা একই রকম। শেষ মুহূর্তে ট্রেনের খবর পাওয়া মাত্র প্ল্যাটফর্মে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ভিড়। যার জেরে প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। তবু ছবিটা পাল্টায় না। কারণ, পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা থেকে ট্রেনের সময়ানুবর্তিতার অভাব, সব ত্রুটি ঢাকার একটাই ওষুধ। ডিসপ্লে বোর্ডে কিছু না লিখে প্ল্যাটফর্মে ঘোষণার উপরেই বরাবর জোর দেওয়া হয় অধিকাংশ স্টেশনে। রেলের যুক্তি, বড় এবং মাঝারি স্টেশন ছাড়া ডিসপ্লে বোর্ডও সব জায়গায় নেই। তা ছাড়া, সব যাত্রী ডিসপ্লে বোর্ড দেখার ক্ষেত্রে সমান পারদর্শীও নন। ফলে ঘোষণাই একমাত্র ভরসা।
এ দিকে, সমস্যার মূল সেখানেই বলে অভিযোগ যাত্রীদের। অভিযোগ, বড় জংশনে থাকলেও শহরতলির মাঝারি স্টেশনগুলিতে ঘোষণায় কোনও নিয়ম-নীতির বালাই নেই। শেষ মুহূর্তে ঘোষণার সমস্যা তো আছেই, তার সঙ্গে আছে ভুল তথ্য দেওয়ার মতো ঘটনাও। পাশাপাশি অস্পষ্ট, জড়িয়ে যাওয়া স্বরে দ্রুত এবং দায়সারা ঘোষণার সমস্যাও আছে। কোথাও কোথাও যান্ত্রিক কারণে ঘোষণা ঠিকমতো শোনা যায় না বলেও অভিযোগ। যাত্রীদের অনেকেরই বক্তব্য, ছোট স্টেশনে নিয়মিত ঘোষণার কোনও বালাই নেই। ট্রেন আসার মিনিট কয়েক আগে দায়সারা ঘোষণা হয়। ঘোষণা ছাড়াই ট্রেন চলে যায় কখনও কখনও। পূর্ব রেল এবং দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ছোট মাপের স্টেশনগুলিতে সব সময়ে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম কাজ করে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি ?
রেল সূত্রে খবর, বড় এবং মাঝারি স্টেশনগুলিতে ট্রেন আসার ঘোষণার খবর জানানোর জন্য নির্দিষ্ট সফ্টওয়্যার রয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওই সফ্টওয়্যারে তথ্য দিলে ঘোষণায় কোনও অসুবিধে হয় না। পাশাপাশি, স্বতন্ত্র ভাবে মাইক্রোফোনেও ঘোষণার সুযোগ রয়েছে। সফ্টওয়্যারের মাধ্যামে ঘোষণার ক্ষেত্রে মেশিনে তথ্য দিতে ভুল না করলে ঘোষণায় ভুল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কখনও কখনও তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও ভুল হয়ে যায় বলে রেল সূত্রের খবর। সমস্যাটা বেশি হয় বিভিন্ন দূরপাল্লার ট্রেন দেরিতে ছাড়লে, রেল অবরোধ হলে কিংবা খারাপ আবহাওয়ার ক্ষেত্রে। রেলের একটি সূত্রের বক্তব্য, সময়মতো রেক না পাওয়ার মতো কারণে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত বদলের ক্ষেত্রেও মাঝেমধ্যে ঘোষণায় বিপত্তি ঘটে।
এমন যাত্রী-বিপত্তির কারণ হিসেবে রেলের ব্যবস্থাপনাকেই দূষছেন আধিকারিকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, বড় থেকে ছোট, কোনও স্টেশনেই ঘোষণার দায়িত্ব পালনের জন্য আলাদা কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা নেই। রেলের বাণিজ্যিক শাখার কর্মীদেরই অনান্য কাজ সামলে ঘোষণা করতে হয়। ছোট স্টেশনগুলির ক্ষেত্রে স্টেশন মাস্টারকেই সিগন্যালিং এবং প্যানেল সামলানো থেকে ঘোষণা, যাবতীয় দায়িত্ব একা হাতে সামলাতে হয়। কখনও কখনও টিকিট বিক্রির দায়িত্বও ঘাড়ে চাপে তাঁর। এমন পরিস্থিতিতে ট্রেন আসার খবর ঘোষণা করার জন্য প্রায়ই খুব অল্প সময় পড়ে থাকে। কোনও বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা থাকলে তা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার করার মতো পর্যাপ্ত সময় হাতে থাকে না। কখনও কখনও অব্যবহারে যন্ত্রও বিকল হয়ে থাকে। অর্থাৎ, বহু ক্ষেত্রে কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই দায়সারা ভাবে ঘোষণার কাজ করতে গিয়ে তার উদ্দেশ্য সফল হয় না। অথচ দুর্ঘটনা এড়াতে ঠিক ঘোষণার উপরেই নির্ভর করার কথা বলেন রেলকর্তারা। অর্থাৎ, গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টিই সবচেয়ে উপেক্ষিত কাজ বলে দাবি রেলকর্মীদের। রেলের এক আধিকারিক বলেন, “ঘোষণার জন্য এক সময়ে রেলে কর্মীদের অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও খরচ বাঁচাতে গিয়ে বহু কাল সে সবের পাট চুকে গিয়েছে। ফলে অপেশাদার, প্রশিক্ষণহীন কর্মীদের হাতে ঘোষণার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার সমস্যা চলছেই।”
সাঁতরাগাছি ফুটব্রিজে দুর্ঘটনার পরে একান্ত বাধ্য না হলে ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম না বদলানোর পরামর্শ দিয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার পূর্ণেন্দু শেখর মিশ্র। বদলের ক্ষেত্রে তা আগে জানানোর পরামর্শও দিয়েছেন। শিয়ালদহ শাখাতেও পুজোয় ভিড়ের সময়ে বা মিটিং-মিছিলের দিনে একই নির্দেশ দেওয়া থাকে। কিন্তু এতে ঘোষকের চাপ কমানো গেলেও দক্ষতা বাড়ানো যায় না বলে দাবি রেলকর্মীদেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy