Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Newborn Baby

মা-হারা অসুস্থ একরত্তিকে বাঁচাতে লড়াই পরিবারের

গত শনিবার মেয়ের জন্ম দেন রিমা। রবিবার দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়। 

তিন দিনের সেই শিশু। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র

তিন দিনের সেই শিশু। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২০ ০৫:০০
Share: Save:

গত রবিবার তার মায়ের মৃত্যুতে যখন ব্যাপক শোরগোল চলছে সরকারি হাসপাতালে, পুলিশ ঘিরে দিয়েছে এলাকা, তখন তাকে নিয়ে ব্যস্ত ওই হাসপাতালেরই প্রসূতি বিভাগের আরও কয়েক জন মা। কে তাকে স্তন্যপান করাবেন, তা নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি চলছে। সেখানেই নার্সের ধমক শুনে এক মহিলা বলে ওঠেন, “আমাদের মুখ খোলাবেন না। এইটুকু বাচ্চার মা কেন বেঁচে নেই, আমরা জানি। নিজের কাজ করুন, আমরা সকলেই ওর মা!”

বাঘা যতীনের বাসিন্দা, তিন দিনের ওই শিশুটির মা রিমা বসুর মৃত্যুতে বাঘা যতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ করেছেন মৃতার স্বামী পুষ্কর। প্রসবের আগে যন্ত্র খারাপ থাকার কথা জানিয়ে ওই হাসপাতাল রিমার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করতে রাজি হয়নি বলে অভিযোগ। এমনকি, লকডাউনে চিকিৎসক না যাওয়ায় ওই প্রসূতিকে হাসপাতালের কেউ দেখতেই চাননি বলে অভিযোগ। গত শনিবার মেয়ের জন্ম দেন রিমা। রবিবার দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়।

মায়ের মৃত্যুর পরে রবিবারই দু’দিনের ওই শিশুটিকে কার্যত জোর করে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যান তার পরিবারের লোকজন। এখনও শিশুটির অবস্থা যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। ১ কেজি ৯০০ গ্রাম ওজনের ওই শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পরেই টেলি-মেডিসিন পদ্ধতিতে এক চিকিৎসককে দেখানো হয়। দিনভর নিয়ম করে ল্যাকটোজেন খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি কয়েকটি পরীক্ষাও করাতে বলেন চিকিৎসক। মঙ্গলবার সেই পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, শিশুটির জন্ডিস রয়েছে। রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক বলেছেন, “ওকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করানো ভাল।” যদিও তার পরিবার আর সে পথে হাঁটতে চায়নি। শিশুটির ঠাকুরমা চিত্রা বসু এ দিন বলেন, “আমার বৌমা হাসপাতালের জন্যই মারা গিয়েছে। আমার ছেলে এখনও সর্বক্ষণ প্রবল অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। মাঝেমধ্যেই কেঁদে উঠছে। বৌমাকে তো হারিয়েছি। কোনও হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নাতনিটাকে হারাতে পারব না।”

ওই পরিবার জানাচ্ছে, রিমার স্বামীর এখনকার মানসিক অবস্থা দেখেই শিশুটিকে ব্রহ্মপুর এলাকায় তার বড়মার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি এমনই যে, এখনও তার নামকরণ করা যায়নি। সেখানে শিশুটিকে নিয়ে সময় কাটছে দুই পিসি, বছর ছাব্বিশের শিল্পী বসু ও বছর কুড়ির রিনিকা রায়ের। রয়েছেন রিনিকার মা রূপাদেবীও। নাম দেওয়া না হলেও বাড়ির লোকজন তাকে পিহু বলে ডাকা শুরু করেছেন।

কেমন কাটছে ওই একরত্তির সময়? পরিবারের লোকজন জানাচ্ছেন, সোমবার বাড়িতে থাকার প্রথম দিন সে কোনও সমস্যায় ফেলেনি। কিন্তু রাতে তার কিছুতেই ঘুম আসে না। পালা করে জাগতে হচ্ছে বাড়ির সকলকে। চিকিৎসকের পরামর্শে বার বার নিয়ম করে খাইয়ে যেতে হয়েছে ল্যাকটোজেন। রূপাদেবী বললেন, “পালা করে রাত জাগছি আমরা। ওজন এত কম যে, ভাল করে খাওয়াতে হচ্ছে। কিন্তু বুকের দুধই তো পাচ্ছে না বাচ্চাটা। এক জন মা যা বোঝেন, আমরা এত জনেও কি তা বুঝতে পারব!” সংশয় যাচ্ছে না বেঙ্গালুরুর একটি সংস্থায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হিসেবে কর্মরত পিসি শিল্পীরও। বললেন, “এসেছিলাম পিসি হওয়ার আনন্দ নিয়ে। এখন অফিসে চিঠি লিখে বৌদির মৃত্যুর খবর জানাতে হচ্ছে। মেয়েটাকে দেখাশোনা করার জন্য ক’দিনের ছুটি নেব ভাবছি। কিন্তু এ ভাবে ক’দিন চালাতে পারব জানি না।”

আজ, বুধবারই আবার শিল্পীর জন্মদিন। নিজের জন্মদিনে ভাইঝির জন্য কী পরিকল্পনা? শিল্পী বললেন, “জন্মদিন ব্যাপারটা কী, বুঝে ওঠার আগেই ওর মা রইল না। জন্মদিন এলেই তো ওর মায়ের কথা মনে হবে। ওকে সব ভোলাতে আমাদের প্রত্যেকের জন্মদিন এ বার থেকে ওর জন্য পালিত হবে। আমার দাদার অবস্থা খুব খারাপ। ভাবছি, দাদাকে দু’দিন মেয়ের কাছে এনে রাখব।”

যাকে নিয়ে এত কথা, সে শুধু হাত বাড়াচ্ছে বিছানায় রাখা পিসির ল্যাপটপের দিকে। তাতে টাইপ হচ্ছে পরিবারে মৃত্যুর খবর জানিয়ে ছুটির দরখাস্ত...!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Newborn Baby Baghajatin
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE