এই ওষুধই উদ্ধার করেছে এনসিবি। নিজস্ব চিত্র
মুঠো মুঠো ঘুমের ওষুধ কলকাতা থেকে পাচার হচ্ছে মার্কিন মুলুকে। কোনও প্রেসক্রিপশন ছাড়াই।
কলকাতায় যে ১০টি ঘুমের ওষুধের স্ট্রিপের দাম ৫০ টাকা, মার্কিন দেশে তা বিক্রি হচ্ছে ২০০ ডলারে! মানে ভারতীয় মুদ্রায় সাড়ে ১৪ হাজার টাকা! আর যাঁরা কলকাতায় বসে এই ব্যবসা ফেঁদেছেন, তাঁরা রাতারাতি ধনকুবের হয়ে উঠছেন।সম্প্রতি কলকাতা থেকে এই ওষুধ পাচারের একটি চক্রকে ধরেছে নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)। প্রধানত যিনি এই পাচার চক্র চালাচ্ছিলেন, ৪০ বছরের সেই ক্লেমেন্ট ফিলিপ আদতে কলকাতারই বাসিন্দা। কসবা চত্বরে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বেআইনি ভাবে ঘুমের ওষুধ পাচারের জন্য তিনি দক্ষিণ কলকাতায় রীতিমতো একটি ‘কল সেন্টার’ খুলে বসেছিলেন। সেখানে রাত ৯টা থেকে ভোর ৪টে পর্যন্ত জনা আটেক কর্মী কাজ করতেন। তাঁদের মধ্যে বি-টেক, আইটি বিশেষজ্ঞও ছিলেন। বেতন ও ভাতা মিলিয়ে তাঁদের কেউ কেউ মাসে ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত
রোজগার করতেন।
এনসিবি-র পূর্ব ভারতের অধিকর্তা দিলীপ শ্রীবাস্তব বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, মার্কিন মুলুক বা কানাডায় প্রধানত নেশা করার জন্য যাঁদের ওই ওষুধের প্রয়োজন হত, তাঁরাই ইন্টারনেটে চাহিদার কথা জানাতেন। সফ্টওয়্যার মারফত ফিলিপের কল সেন্টারের কর্মীরা সেই চাহিদার কথা জেনে ফোনে যোগাযোগ করতেন ক্রেতার সঙ্গে। শুরু হত দরদাম। সেই দরদাম চূড়ান্ত হলে ক্রেতা কার্ড মারফত দাম মেটাতেন। টাকা দেওয়ার সাত দিনের মধ্যে ক্রেতার কাছে ক্যুরিয়র সার্ভিসের ট্র্যাকিং নম্বর পাঠিয়ে দেওয়া হত। ২১ দিনের মধ্যে ক্রেতার বাড়িতে পৌঁছে যেত ওষুধ।
কোথা থেকে এই ওষুধ পেতেন ফিলিপ?
দিলীপবাবু জানিয়েছেন, ওষুধ জোগাড়ের ক্ষেত্রে গণেশ পুন এবং সুনীল অগ্রবাল নামে দুই যুবক সাহায্য করতেন ফিলিপকে। গণেশ আদতে নেপালের বাসিন্দা, কিন্তু তিনিও দীর্ঘদিন ধরে কলকাতায় রয়েছেন। মহেশতলার কাছে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। সুনীল থাকতেন শ্যামনগরে। সুনীলের কাজ ছিল বিভিন্ন ওষুধের দোকান ঘুরে বিশেষ কয়েকটি ধরনের ঘুমের ওষুধ জোগাড় করে তা গণেশের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তার জন্য কিছু টাকা পেতেন সুনীল। ফিলিপের কাছে যা অর্ডার আসত, তা চলে যেত গণেশের কাছে। গণেশ সেইমতো ওষুধ প্যাকেটে করে ক্যুরিয়র করে দিতেন। গণেশ প্রতিটি ট্যাবলেটের জন্য ১ থেকে ২ ডলার পেতেন। ক্যুরিয়র যেত গণেশের নাম করেই। সেখানে কখনও লেখা থাকত ‘নথিপত্র’, কখনও বা লেখা হত ‘খেলনা’।
গণেশের নামই প্রথমে জানতে পারেন এনসিবি অফিসারেরা। মাস খানেক আগে দিল্লিতে ‘নথিপত্র’ লেখা একটি প্যাকেট ধরা পড়ে। খুলে দেখা যায়, তার ভিতরে প্রচুর ঘুমের ওষুধ রয়েছে। প্রেরকের জায়গায় গণেশের নাম ও কলকাতার একটি ঠিকানা লেখা। তদন্তে নামেন কলকাতার এনসিবি অফিসারেরা। কিন্তু ক্যুরিয়রের প্যাকেটে গণেশের কলকাতার যে ঠিকানা লেখা ছিল, সেখানে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। শুরু হয় খোঁজ। গত সোমবার মহেশতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে গণেশ ধরা পড়েন। এক সময়ে তিনিও ফিলিপের কল সেন্টারে কাজ করতেন। কিন্তু পরে দেখেছেন প্রেরকের কাজ করলে মুনাফা অনেক বেশি। তাঁর ফ্ল্যাট থেকে প্রচুর ওষুধও পাওয়া গিয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
তাঁকে জেরা করেই বুধবার কসবা ও শ্যামনগর থেকে ধরা হয় ফিলিপ এবং সুনীলকে। গণেশকে আগেই আদালতে পেশ করে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিলেন অফিসারেরা। বৃহস্পতিবার তাঁদের তিন জনকে আবার আদালতে পেশ করা হয়। তিন জনের কাছ থেকে তিন হাজারের বেশি ট্যাবলেট পাওয়া গিয়েছে।
দিলীপবাবু জানিয়েছেন, ইন্টারনেট মারফত ওষুধ বিক্রি বেআইনি নয়। যাঁরা করছেন, তাঁরা সরকারের নিয়ম মেনে করছেন। সেখানে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ দেওয়া হয় না। কিন্তু ফিলিপ যে ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলেন, সেখানে প্রেসক্রিপশন ছাড়া, অন্য সামগ্রীর নাম করে মার্কিন মুলুকে ছ’ধরনের ঘুমের ওষুধ পাচার করা হচ্ছিল। গত ছ’বছর ধরে ফিলিপ এই ব্যবসা চালাচ্ছিলেন। দিলীপবাবুর আশঙ্কা, শুধু কলকাতা নয়, সারা দেশে এমন বহু যুবক বড় অঙ্কের মুনাফার লোভে বিদেশে এ ভাবে ওষুধ পাচার করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy