প্রতীকী ছবি।
ব্রিটিশ শাসন নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপের সুরে লিখেছিলেন, ‘‘হায় লাঠি, তোমার দিন গিয়াছে!’’ ই-মেল, এসএমএস, হোয়াট্সঅ্যাপের দৌলতে বাঙালি বলতেই পারে, হায় চিঠি, তোমারও দিন গিয়েছে!
তিন দশক আগেও বিজয়ার পরে বাড়িতে গোছা গোছা পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার কেনা হতো। চিঠি লেখাকে সাহিত্যের পর্যায়েও নিয়ে গিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের দিকপালেরা। চিঠির মাধ্যমে গজিয়ে উঠত বন্ধুত্ব। চোখে না দেখেও মাসের পর মাস শুধু কাগজে লেখা অক্ষরেই বেঁচে থাকত সম্পর্ক।
প্রযুক্তির হাত ধরে সেই রেওয়াজ বদলে গিয়েছে। এখন চটজলদি ফোনে বা গ্রুপ এসএমএসেই শুভেচ্ছা বিনিময় সেরে ফেলেন লোকজন। ফেসবুকে চিঠির কায়দায় তৈরি হয় প্রতিবাদ, অণুগল্প। ইন্টারনেটের ভিডিও-চ্যাটে মুখোমুখি আড্ডা জমে।
সেই স্মৃতিকেই উস্কে দিতে আমজনতা, বিশেষত নতুন প্রজন্মের মধ্যে চিঠি লেখা নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে ডাক বিভাগ। সার্কেল থেকে জাতীয় স্তর, সেরা চিঠি লিখিয়েদের পুরস্কৃতও করা হবে। ডাক বিভাগ সূত্রের খবর, চিঠি লেখার বিষয় ‘বাপু তুমিই আমার প্রেরণা’। দেশের সেরা চিঠিগুলি বেছে নিয়ে মহাত্মা গাঁধীর জন্মদিনে সাবরমতী আশ্রমে করা হবে প্রদর্শনীও।
ডাক বিভাগ জানিয়েছে, মহানগরে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে পড়ুয়াদের নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করছেন ডাক বিভাগের সিনিয়র সুপারিনটেন্ডেন্ট পুনীত বিজরনিয়া এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট মিতালি দে। এ ছাড়াও যে কেউ ইনল্যান্ড লেটার (অনধিক ৫০০ শব্দ) বা এ-ফোর কাগজে (অনধিক ১০০০ শব্দ) চিঠি লিখে ১৫ অগস্টের মধ্যে বিভিন্ন ডাকঘরের বিশেষ লেটার বক্সে জমা দিতে পারেন।
অনেকেরই প্রশ্ন, প্রতিযোগিতা করলেই চিঠি লেখার রেওয়াজ ফিরবে কি? এসএমএস, হোয়াট্সঅ্যাপ ছেড়ে লোকে চিঠি লেখা শুরু করবে এমন আশা করেন না ডাক কর্তারাও। চিফ পোস্টমাস্টার জেনারেল অরুন্ধতী ঘোষের মতে, চিঠি সংস্কৃতির অঙ্গ। সেই সংস্কৃতিকে বাঁচাতেই এই ধরনের প্রতিযোগিতা। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনস্থ সংস্থা ‘ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন’ ফি বছর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চিঠি লেখার প্রতিযোগিতা করে।
অরুন্ধতীদেবীর বাবা-মা বহু দিন হল প্রয়াত। কিন্তু তাঁদের লেখা চিঠি তিনি রেখে দিয়েছেন। তিনি বলছেন, ‘‘চিঠিগুলোর মধ্যে দিয়েই বাবা-মায়ের ছোঁয়া পাই।’’ এই নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে লেখক নবনীতা দেবসেন বলেন, ‘‘সরকার এমন প্রকল্প সাধারণত নেয় না। এটা খুব ভাল দিক।’’ এখনও দেশে যাঁদের ই-মেল, হোয়াট্সঅ্যাপ নেই, তাঁদের চিঠি পাঠান নবনীতা। ফ্যানেদের পাঠানো চিঠি রেখেও দেন তিনি।
চিঠি হারানোর আক্ষেপ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়েরও। বাবা-মা থেকে শুরু করে বনফুল, প্রমথনাথ বিশীর মতো বিশিষ্টদের চিঠি ছিল তাঁর কাছে। প্রতিযোগিতা নিয়ে তিনি বলছেন, ‘‘উদ্দেশ্যটা ভাল। কিন্তু চিঠি লেখার প্রয়োজনটাই তো চলে গিয়েছে।’’ শহরের বাইরে থাকার সময়ে মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেতেন পরিচালক অনীক দত্ত। ব্যক্তিগত চিঠির স্মৃতি বলতে সেটুকুই। তাঁর মতে, কালের নিয়মে কিছু জিনিস হারিয়ে যায়। চিঠি তেমনই। নয়া প্রজন্ম যদি চিঠির বদলে ই-মেল, হোয়াট্সঅ্যাপে প্রেমপত্র লেখে, তাতে রোম্যান্টিসিজমের ঘাটতি হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy