Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দুই স্ত্রী ও দুই সন্তানকে মেরে বাঁচল না নিজেও

ঘরের মধ্যে চাপ চাপ রক্ত। বসার ঘরের মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন এক মহিলা। পোশাক অবিন্যস্ত। সারা গায়ে ক্ষতচিহ্ন। গলার নলি কাটা।কয়েক পা দূরেই শোয়ার ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছেন বছর চল্লিশের এক পুরুষ। উলঙ্গ দেহ। ডান হাতের শিরা কাটা। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে পুরুষাঙ্গও। ঘর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ওই ব্যক্তির সামনেই বিছানায় পড়ে বছর তিনেকের একটি শিশুর দেহ। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে পেট থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্ত্রের অংশ।

হরিনাভির ফ্ল্যাটে রক্তে লাল বিছানা।  —নিজস্ব চিত্র

হরিনাভির ফ্ল্যাটে রক্তে লাল বিছানা। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৩৫
Share: Save:

ঘরের মধ্যে চাপ চাপ রক্ত। বসার ঘরের মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন এক মহিলা। পোশাক অবিন্যস্ত। সারা গায়ে ক্ষতচিহ্ন। গলার নলি কাটা।

কয়েক পা দূরেই শোয়ার ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছেন বছর চল্লিশের এক পুরুষ। উলঙ্গ দেহ। ডান হাতের শিরা কাটা। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে পুরুষাঙ্গও। ঘর ভেসে যাচ্ছে রক্তে।

ওই ব্যক্তির সামনেই বিছানায় পড়ে বছর তিনেকের একটি শিশুর দেহ। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে পেট থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্ত্রের অংশ।

বৃহস্পতিবার দুপুরে গরফা পূর্বাচলের এক বন্ধ ফ্ল্যাট থেকে এমনই তিনটি দেহ উদ্ধার করল পুলিশ। যার কয়েক ঘণ্টা আগেই সোনারপুরের হরিনাভির একটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক মহিলা ও তাঁর বছর বারোর ছেলের নলিকাটা দেহ। পুলিশের দাবি, এই দু’টি হত্যা-কাণ্ডই একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। কী ভাবে?

পুলিশ জানায়, গরফায় উদ্ধার হওয়া তিন জনের নাম শঙ্কর কর্মকার (৪০), রোহিণী চক্রবর্তী (৩৩) এবং ইয়াশি (৩)। এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শঙ্কর-রোহিণী স্বামী-স্ত্রীর মতোই থাকতেন। ইয়াশিকেও তাঁদের সন্তান বলেই এলাকায় জানিয়েছিলেন। হরিনাভির ফ্ল্যাটটিও শঙ্করের। সেখানে উদ্ধার হওয়া মহিলা পৌলমী কর্মকার (৩৩) শঙ্করের বিবাহিত স্ত্রী, অরিত্র কর্মকার (১২) তাঁদের সন্তান। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত, পেশায় জমি-বাড়ির কারবারি শঙ্করই প্রথমে স্ত্রী পৌলমী এবং পুত্র অরিত্রকে খুন করেছেন। পরে গরফার বাড়িতে এসে তিনিই বাকি দু’জনকে খুন করেন। তবে শঙ্কর আত্মহত্যা করেছেন নাকি রোহিণীই তাঁকে খুন করেছেন, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত নয় পুলিশ।

লালবাজারের এক কর্তা বলেন, রোহিণীর শরীরে একাধিক ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। শঙ্করের শরীরের ক্ষত দেখেও তদন্তকারীরা মনে করছেন, হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যার ঘটনা এটি নয়। শঙ্করের পুরুষাঙ্গ যে ভাবে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে, তা দেখে তদন্তকারীদের প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছে, এই কাজ তাঁর নিজের পক্ষে করা সম্ভব নয়। রোহিণীই এই কাজ করতে পারেন বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে পুলিশ। তবে কী করে ঘটনাটি ঘটেছে, সে ব্যাপারে তদন্তকারীরা এখনও অন্ধকারে।

ঘটনার তদন্তে নেমে কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশ বেশ কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। পুলিশ সূত্রের খবর, শঙ্কর বুধবার রাতে হরিনাভির ফ্ল্যাটেই ছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার সুমিত চক্রবর্তী ওরফে বোমকে দিয়ে একটি মদের বোতল কিনে আনান তিনি। এর পরে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ফ্ল্যাটের দরজা বাইরে থেকে চাবি দিয়ে বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে ফ্ল্যাটের চাবি কেয়ারটেকারকে দিয়ে বলেন, সকালে দরজা খুলে স্ত্রী ও ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে দিতে। সেই মতো এ দিন সকালে সুমিতই ফ্ল্যাটের দরজা খুলে পৌলমী ও অরিত্রর মৃতদেহ দেখেন।

পুলিশ সূত্রের খবর, বিছানার উপরে পৌলমীর মৃতদেহ চিত্‌ হয়ে পড়েছিল। পৌলমীর গলার নলিকাটা ও মুখে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আর পাশের ঘরের বিছানায় ছেলে অরিত্রের মৃতদেহ মুখ থুবড়ে পড়েছিল বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। দু’টি মৃতদেহের পাশেই রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। পুলিশ জানায়, ঘরের ভিতর থেকে একটি মদের বোতল ও একটি বড় ছুরি মিলেছে। মিলেছে রক্ত মাখা হাফপ্যান্টও। তদন্তকারীদের অনুমান, খুন করার সময়ে ওই হাফপ্যান্টটিই পরেছিলেন শঙ্কর। ফ্ল্যাট ছেড়ে পালানোর সময়ে প্যান্টটি ছেড়ে অন্য পোশাক পরে নেন তিনি। হরিনাভির ফ্ল্যাট ছেড়ে যাওয়ার সময়ে শঙ্করের সঙ্গে তাঁর গাড়িচালক ধর্মেন্দ্রও ছিলেন বলেও জানান সুমিত। ধর্মেন্দ্রর সঙ্গেও এ দিন কথা বলেছেন তদন্তকারীরা।

পুলিশ সূত্রের খবর, এই খুনের সঙ্গে যে শঙ্কর যুক্ত, সে বিষয়ে এ দিন সকালেই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান তদন্তকারীরা। এক তদন্তকারীর কথায়, জমাট বাঁধা রক্তের নমুনা দেখে প্রাথমিক ভাবে বোঝা যায়, প্রায় ঘণ্টা দশেক আগে খুন দু’টি করা হয়েছে। সময় মিলিয়ে দেখা যায় তখন ঘরেই ছিলেন শঙ্কর। পৌলমীর ঘরে পড়ে থাকা শঙ্করের হাফপ্যান্টেও রক্তের দাগ রয়েছে। এর পরেই তদন্তকারীরা শঙ্করের খোঁজ করতে শুরু করেন।

পুলিশ সূত্রের খবর, শঙ্করের মোবাইলে টাওয়ার লোকেশন ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি হরিনাভি থেকে বেরিয়ে গরফা পূর্বাচল এলাকায় গিয়েছিলেন। রাতে তিনি সেখানেই ছিলেন বলে জানা যায়।

লালবাজার সূত্রের খবর, গরফা পূর্বাচল এলাকায় একটি বহুতলের দোতলায় ফ্ল্যাট ছিল শঙ্করের। প্রতিবেশীরা জানান, বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই ফ্ল্যাটের ভিতরে চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পরে সব চুপচাপ হয়ে যায়। দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ রোহিণীর ভাই ওই ফ্ল্যাটে আসেন। ডাকাডাকি করে বোনের সাড়া না পেয়ে তিনি রান্নাঘরের একটি জানলা দিয়ে উঁকি মারেন। তিনিই প্রথম রোহিণীকে রক্তাক্ত অবস্থায় বসার ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন বলে পুলিশের দাবি। পরে রান্নাঘরের জানলার কাচ সরিয়ে ভিতরে ঢুকে পুরো ঘটনাটি বুঝতে পারেন তিনি। এর পরেই তিনি ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সব জানান।

কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, গরফার ফ্ল্যাটের ভিতর থেকেও একটি আধখাওয়া মদের বোতল মিলেছে। খাবার টেবিলে প্লেটে রাখা খাবারও মিলেছে। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, হরিনাভি থেকে স্ত্রী ও ছেলেকে খুন করে এসে গরফার ফ্ল্যাটে ঠাঁই নিয়েছিলেন শঙ্কর। তবে গরফার ফ্ল্যাটে কে কখন মারা গেল এবং কে কাকে কী ভাবে মেরেছে, তা নিয়ে ধন্দে তদন্তকারীরা। “এ রকম ঘটনা খুবই অদ্ভুত। ঘটনাক্রম সাজানো যাচ্ছে না। বেশ কিছু উত্তর রাত পর্যন্ত পাওয়া যায়নি,” বলছেন গোয়েন্দাপ্রধান। পুলিশ জানায়, প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, মত্ত অবস্থায় শঙ্কর তিন বছরের ইয়াশিকে বালিশ চাপা গিয়ে খুন করেন। পরে তার পেট চিরে দেন। শিশুটির দেহের পাশে একটি রক্ত মাখা ব্লেডও মিলেছে বলে তদন্তকারীরা জানান। ছেলের মৃত্যু দেখে ক্ষিপ্ত রোহিণী ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করেন শঙ্করকে। মারামারির মধ্যেই জখম হন রোহিণীও। তাঁর শরীরেও একাধিক আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। দু’টি ধারালো ব্লেড ছাড়াও ঘরে একটি ধারালো ছুরি মিলেছে। তদন্তকারীদের অনুমান, ওই ছুরি ঘায়েই ধরাশায়ী হন শঙ্কর। তবে এই সময়ে ঠিক কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে ধন্দ রয়েছে তদন্তকারীদের মধ্যে। শঙ্করের ডান কব্জির শিরা তিনি নিজেই কেটেছিলেন না রোহিণী কেটে দেন, তা জানার জন্য চিকিত্‌সকদের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। তদন্তকারীরা জানান, দু’জনের শরীরেই এত জখমের চিহ্ন রয়েছে, যে সেগুলির কোনটি কী ভাবে, কী অস্ত্রে হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে না। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, ক্ষতগুলি থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ার ফলেই দু’জন মারা গিয়েছেন। কার মৃত্যু প্রথমে হয়েছে, তা-ও চিকিত্‌সকদের কাছে জানতে চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

shankar karmakar murder harinavi garfa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE