উত্তরবঙ্গের রাজবংশী/ চারুচন্দ্র সান্যাল
অনুবাদক: তৃপ্তি সান্ত্রা
৫০০.০০
আনন্দ পাবলিশার্স
মানুষের পরিচয় জানতে গিয়ে কখনও আদিগন্ত জনপদও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেই অন্বেষকের দৃষ্টিতে জড়িয়ে থাকে আত্মমগ্নতা। চরাচর আর সময়ের মানদণ্ডে প্রতিবেশ পরিজনকে জানা সমাজ গবেষণার অন্যতম ধারা। কোনও জনগোষ্ঠীর সমাজ-সাংস্কৃতিক অন্তর্জগৎ দেখা-ও নানা প্রেক্ষিতেই ভিন্নধর্মী হতে পারে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের জনগোষ্ঠীগত সংস্কৃতির যে নিজস্ব বলয় তা সেখানকার ভূ-বিন্যাস, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সামাজিক রীতিনীতি, ভাষাবৈশিষ্ট্য, উৎসব, পার্বণ, শিল্পশৈলীতে ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচ তৈরি করে— যা এলাকাভেদে স্বতন্ত্র। বৃহত্তর মাপকাঠিতে এ সবের খোঁজ শুধু অন্বেষণে নয়— অনুভবেও তৈরি হয় গবেষণার অন্তরকথা।
তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, করতোয়া, সঙ্কোশ— এমন কত নদনদীর প্রবাহ আর প্রকৃতিতে মেশা গ্রাম-জনপদে বাংলার রাজবংশী জনগোষ্ঠীর যে নিরীক্ষণ করেছিলেন চারুচন্দ্র সান্যাল তা সময়েরই দৃশ্যকথা। ১৯৬৫ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত দ্য রাজবংশিজ অব নর্থ বেঙ্গল/ আ স্টাডি অব আ হিন্দু সোশ্যাল গ্রুপ শিরোনামে ইতিহাসের বয়ান, এ সময়ের অনুবাদে নতুন করে ফিরে পাওয়া। চারুচন্দ্র সান্যালের প্রতিবেশ অনুসন্ধান শুধুমাত্র পরিচয় বর্ণনার প্রয়াস ছিল না, তাতে সংলগ্ন সমাজজীবনকে দেখার চেতনাও ছিল। তাঁর সার্বিক চর্চায় দার্জিলিঙের তরাই, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের বিস্তৃত চৌহদ্দির উদাহরণীয় আলোচনা থাকলেও কথাসূত্রে তা বাংলার উত্তরের সংশ্লিষ্ট জেলা ও রাজ্য এমনকী বহির্দেশেও ব্যাপ্ত। বাংলার উত্তর ও উত্তর-পূর্বের মঙ্গোল জাতিচরিত্রের জনজাতীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যে নৃগোষ্ঠীগত বিভাগ, সম্পর্ক ও ভাষাভিত্তিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তাতে কোচ, মেচ, বোড়ো ইত্যাদির সঙ্গে রাজবংশী জনগোষ্ঠীর পরিচয়ের সূত্রসন্ধান পাওয়া যায়।
প্রশাসনিক চৌহদ্দি পরবর্তীতে কিছু পরিবর্তিত হলেও, বসবাসকারী রাজবংশীদের ঐতিহাসিক ও জাতিতাত্ত্বিক বিষয়, জনবিন্যাস, রাজবংশ, গ্রাম, কুটিরস্থাপত্য, পেশা, ভাষা, জন্ম-বিবাহ-মৃত্যু নিয়ে নিয়মাচার, সামাজিক সংগঠন, রীতিনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, পুজো-আচার, ধাঁধা, প্রবাদ, নাচগান, খেলাধুলো ইত্যাদির বহুকৌণিক অবগাহন এই অন্বেষণ। গ্রামনামের উৎপত্তি থেকে খাদ্যাভ্যাস, আচার-অনুষ্ঠানের পর্যায়ক্রমিক বিষয়ে কোনও জনগোষ্ঠীর চর্চায় সন্ধানী আলো ফেলা এই নিরীক্ষণের অন্যতম দিক। এ সবের খোঁজ কত আবিষ্ট হতে পারে তা এই বিবরণে পাওয়া যায়। ধর্মীয় মতে শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ তন্ত্রশাস্ত্রের মিলমিশে নিজস্ব ধারা গড়ে উঠেছে। আবার, সামাজিক জীবন আর আঞ্চলিক ভাষাশৈলীর শব্দভান্ডারের অজস্র নিদর্শনে সমৃদ্ধ। অন্য দিকে, কৃষি যন্ত্রপাতি, গরুর গাড়ি, মাছ ধরার সরঞ্জাম, তাঁতঘরের যন্ত্রপাতি, বাদ্যযন্ত্র, গ্রামীণ খেলা ও দেবদেবীর রেখাচিত্রও এই বইকে সমৃদ্ধ করেছে। আছে পোশাক-পরিচ্ছদ, গয়না, ঘরবাড়ি, নৃগোষ্ঠীর শারীরিক গঠন-বৈশিষ্ট্যের আলোকচিত্র। একাগ্র অভিনিবেশ, আবেগ আর স্বদেশ ভাবনায় পারিপার্শ্বিক সমাজ-সংস্কৃতির সমকাল খুঁজে খুঁজে জনগোষ্ঠীর উদ্ঘাটনে এই কাজ গবেষণার উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। রাজবংশী জনগোষ্ঠীর জনতাত্ত্বিক পর্যায়ক্রমের ক্ষমতার আদানপ্রদান-সহ সামাজিক অবস্থানের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার হদিস পাওয়া যায়। তাতে আজকের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির রাজপাটের ইতিহাস, জনবিস্তারের প্রকৃতি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র— স্বাধীন রাজ্য থেকে জেলা অন্তর্ভুক্তির সূত্রকথায় আছে ধারাবাহী জাতিসত্তার বহমানতা।
উত্তরবঙ্গেরই মেচ ও আদিম জনজাতীয় গোষ্ঠী টোটো নিয়েও তাঁর গবেষণায় নৃতত্ত্বের স্বাভিমান প্রকাশিত। আর, রাজবংশী জনগোষ্ঠীকে উত্তরবঙ্গের এই বৃহত্তর পরিসরে সার্বিক দৃষ্টিকোণে দেখার মুন্সিয়ানা ও কর্মনিষ্ঠা যে আরামকেদারায় বসে হয়নি তা মূল গ্রন্থে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মুখবন্ধেও তারিফ পেয়েছে। এই অনুবাদ ভাষ্যে অবশ্য সুনীতিকুমারের মুখবন্ধটি সংযোজিত হয়নি। তবে ধৈর্য ধরে পরিশ্রমী অনুবাদের পরেও তৃপ্তি সান্ত্রার দ্বিধাগ্রস্ত অভিমত— ‘‘তাঁর লেখা ও দেখা নিয়ে কী মতান্তর দেখা দেবে?’’ সমাজ-গবেষণার বড় মাপের দিশারী উদ্যোগে অনেক সময়েই কিছু অসম্পূর্ণতা ও ত্রুটি থেকে যায়। বিনয় ঘোষের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি-র সব তথ্য ও মতামত কি আজ ঠিকঠিক মেলানো যাবে? তিনি স্থানভিত্তিক সংস্কৃতিচর্চায় বহুবিচিত্র ব্যঞ্জনা এনেছেন মূলত দক্ষিণবঙ্গের বৃহত্তর ভূখণ্ডে। প্রায় সেই সময়কালে চারুচন্দ্র রাজবংশী জনসমাজ-কেন্দ্রিক উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতি উদ্ঘাটনে বৃহত্তর এক সমাজ-কাঠামোকেই তুলে ধরেছেন। উত্তরবঙ্গ বিনয় ঘোষের চর্চায় ছিল অধরা, তার আজও পরিপূরণ হয়েছে কি? তবুও এ সব উন্মেষপর্বের কাজ বাংলা ও বাঙালিকে আবিষ্কারের অন্যতম আকরসূত্র।
আজকের রাজবংশী সমাজের চর্চা গবেষণায় নিত্যনতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। একই ভাবে, পঞ্চানন বর্মার সমাজ চেতনায় জাতিগোষ্ঠীর বিন্যাসে ক্ষত্রিয় সমাজ-ধর্মের ধারাও বহমান। জনগোষ্ঠীচর্চা মানে নৃতাত্ত্বিক বর্ণনায় শুধু বৈশিষ্ট্য আলোচনা নয়— প্রকৃতি-পরিবেশ-সমাজসম্পর্কের নিজস্ব নির্মাণ। এই নির্মাণেরই অন্যতম সূত্রধর ছিলেন চারুচন্দ্র। তাঁর অনুশীলনও ছিল বহুবিস্তারি। শারীরবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত, স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান ও কারাবন্দিত্ব, প্রায় কুড়ি বছর রাজ্য বিধান পরিষদ ও বিধানসভার সদস্য-সহ আঞ্চলিক সমাজ-সংগঠনের কর্মকাণ্ডে উত্তরবঙ্গের নানা প্রগতিবাদী ভূমিকায় জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর সেই বিশ শতকের মাঝামাঝির স্বতোৎসারিত গবেষণাকর্ম এই সময়কালে অনূদিত হয়ে সাধারণ বাঙালির জ্ঞানচর্চায় আরও কাছাকাছি এল। তাই আজকের রাজবংশী সমাজের কোনও বিদ্যোৎসাহী যদি সার্বিক অন্বেষণ ও আগের কাজের পরিপূরণে প্রয়াসী হন, রূপান্তরের দিশায় চারুচন্দ্রের কাজটি মূল্যবান নিরীক্ষা হিসাবেই গণ্য হবে।
বইটি বহুসংখ্যক তর্কপ্রিয় পাঠকের হাতে এলে, লোকসংস্কৃতির নিরন্তর চর্চায় প্রবীণের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকেও উদ্বুদ্ধ করবে— তা অনুবাদপ্রসঙ্গে জানানো হয়েছে। মতটি নানা দিক থেকেই গ্রহণীয়। বঙ্গদেশে লোকসাহিত্য-ঘেঁষা খণ্ডিত লোকসংস্কৃতিরই ব্যাপকতা। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠচর্চায় লোকসাংস্কৃতিক বিষয়-বৈশিষ্ট্যের অনুশীলনের পদ্ধতিও বহু ক্ষেত্রে দুর্বল। অনেক বিষয়ের আত্তীকরণ ও আদানপ্রদানের মুক্ত চৌহদ্দিতেই সৃষ্টি হতে পারে এমন গবেষণার ভিত্তিভূমি। যা সহজলভ্য নয়। আর, এমন কাজের পরিসর সর্বোপরি গড়ে ওঠে উদার স্বদেশপ্রেমেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy