Advertisement
E-Paper

বাঙালির রান্নার স্বাদ-গন্ধ

‘সূচিকরণ’ নাম দিয়ে লেখক তাঁর বিষয়কে সাজিয়েছেন খাদ্যবস্তুর স্বাদকে অনুসরণ করে। রসনা-স্বাদে যে ছয়টি রসের কথা বলা হয় প্রায় সে ভাবেই তিনি তেতো নুন ঝাল টক ইত্যাদির সবিস্তার আলোচনা করেছেন, বলেছেন শাকের কথা।

শান্তা সেন

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৭ ০০:০০

স্বাদ-সঞ্চয়িতা

লেখক: সামরান হুদা

মূল্য: ৫৫০.০০

প্রকাশক: ৯ঋকাল বুকস

বাঙালি জাতির বেঁচে থাকার ধরনে অঞ্চলবিশেষে গড়ে ওঠে রান্না-খাওয়ার কত বৈচিত্র। মূলত কুমিল্লা ও চট্টগ্রামকে ঘিরে তার গ্রাম ও শহুরে জনপদের দৈনন্দিন রান্নাঘরের বিস্তারিত এক বিবরণ উপস্থিত করেছেন সামরান হুদা তাঁর স্বাদ-সঞ্চয়িতা বইটিতে। সেই আঞ্চলিক রান্না-খাওয়ার কথার মধ্যেই আবার ফুটে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতিরই খাদ্যাভ্যাসের মূল চরিত্র— এই নদীমাতৃক ভূমিতে শস্য শাক সবজি ফল ও মাছের সমন্বয়েই তো তৈরি হয়ে ওঠে তার প্রতিদিনের মুখে তোলার কত পদ। সাধারণ গ্রামীণ মানুষ, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ এবং সম্পন্ন পরিবারেও কত ভাবে কী রান্না করা ও খাওয়া হয়— তার খুঁটিনাটি পরিচয় এই বইটিতে উপস্থিত করেছেন লেখক। তবে কোনও ভাবেই রন্ধনশৈলী বা রেসিপি উপস্থিত করার লক্ষ্যে তা লেখা হয়নি। সমগ্র বইটি জুড়ে আছে এক পরিভ্রমণের আনন্দ— কৌতূহলী ও অনুসন্ধিৎসু এক রসনারসিকের হাত ধরে পাঠক বাঙালির চিরাচরিত রান্না-খাওয়ার আঙিনায় ঘুরে বেড়াতে থাকবেন তার একান্ত নিজস্ব স্বাদ-গন্ধ নিতে নিতে।

‘সূচিকরণ’ নাম দিয়ে লেখক তাঁর বিষয়কে সাজিয়েছেন খাদ্যবস্তুর স্বাদকে অনুসরণ করে। রসনা-স্বাদে যে ছয়টি রসের কথা বলা হয় প্রায় সে ভাবেই তিনি তেতো নুন ঝাল টক ইত্যাদির সবিস্তার আলোচনা করেছেন, বলেছেন শাকের কথা। প্রথমেই তেতো খাওয়া বাঙালির রীতি, তাই তাঁর বিষয়ের সূচনা করলার নানা স্বাদের রান্না নিয়ে, নিমপাতা আর রকমারি সুক্তোর কথায়। এর পরেই অবশ্য তাঁর মন্তব্য, ‘যত সুস্বাদু খাবারই হোক না কেন, নুন না দিলে সব মাটি।’ নুনের কথা বলতে তাঁর লেখায় এসে যায় মুখ্যত নোনা ইলিশ, শুঁটকি মাছ, নানা রকম ভাত আর পান্তা ভাতের কথা। কত রকমেই যে পান্তা খাওয়া হয়— পেঁয়াজ-শুকনো লঙ্কা পোড়া আর নুন, সঙ্গে শুঁটকির ঝাল ঝাল ভর্তা, বৈষ্ণবদের ভোগ পান্তার সঙ্গে দই চিনি ও শাকের তরকারি দিয়ে, গ্রামের মানুষ গরমকালে পান্তা খান পাকা আম আর দশ-বারোটা কাঁঠালের কোয়া দিয়ে। জানা হয় মাদারিপুর জেলার ‘কাজির ভাত’-এর কথা— সাত দিন ধরে জলে ভেজানো টক গন্ধ ছড়ানো চাল দিয়ে যা রান্না হয়, আবার বগুড়া অঞ্চলের বিশিষ্ট ধরনে তৈরি পান্তা ‘বকনি’ খেতে গরমকালে মেয়েরা বাপের বাড়ি যায়। গ্রামের মানুষের কাজকর্মের জীবনে পান্তা কী ভাবে জড়িয়ে থাকে তা শহুরে বাঙালির নিতান্ত অজানা। সামরান এ ভাবে ব্যাপক লোকায়ত জীবনের একটি খাদ্যাভ্যাসের কথা পাঠকের গোচরে আনেন।

‘জলের ভেতর লেখাজোখা’ অধ্যায়টি শুরু একটি পুকুর আর গাছগাছালিতে ভরা গ্রামের বর্ণনা দিয়ে। এই জলময় ভূমি থেকে পাওয়া যায় কত রকমের শাক, হেলেঞ্চা আর কলমি তো বটেই, শুনি ডেঙ্গার ডাঁটা আর শাকের কথা, সাচি (যার ভাল নাম নাকি ‘শালিঞ্চ’), পাটপাতা, মুলোশাক, উষনি, লাফা, টেপেরাই, ঠুনিমানকুনি, সুষনি— আরও অনেক নাম। যে মানুষেরা এই শাক খান, যে ভাবে রান্না হয়, তাকে খেত থেকে তোলা হয়, আর গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই কাজে মন দেন— তার বিবরণে গ্রামের জীবন জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। পাতার পর পাতা জুড়ে যে সব শাকের কথা তার সব কিছুতেই আবার শুঁটকি, সিদল শুঁটকি, কোথাও টাকি মাছের ভর্তা যুক্ত হয়।

ঝালের প্রসঙ্গে এসে সামরান যেন এই স্বাদটির বিশেষ মহিমার কথাই বলেন কিছু গল্পকথার মধ্য দিয়ে। লঙ্কা খাওয়ার কথা তো আছেই, আছে লঙ্কা গাছেরও অসাধারণ বর্ণনা কয়েকটি বাক্য জুড়ে। পরিশিষ্টে আসে অম্লমধুর মোরব্বা আর আচারের কথা। পরিবারের কর্মরত নারীদের শ্রমে ও সযত্ন মনোযোগে তৈরি মোরব্বার কথায় গৃহজীবনের একটি ছবি ভেসে ওঠে যা এখন লুপ্তপ্রায়। বিপুল তথ্য ও নিপুণ পর্যবেক্ষণ নিয়ে লেখা এই বইয়ের কয়টি অধ্যায়, এসেছে ইতিহাসের সূত্রও, যুক্ত হয়েছে অজস্র মেয়েলি ছড়া, সারিগান ও নানা লোকগীতি, বিজয়গুপ্ত, মুকুন্দরাম, বৃন্দাবনদাস, কৃষ্ণদাস প্রমুখের রচনার উদ্ধৃতি। সব কিছু নিয়ে এটি একটি গবেষণাগ্রন্থই হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও এতে নেই গবেষণার নৈর্ব্যক্তিকতা, নেই বিষয়ের গুরুভার। নানা প্রসঙ্গে এসেছে টুকরো গল্পকথা, ছড়িয়ে আছে চারপাশ থেকে তুলে আনা সাধারণ ও সামান্য মানুষের চরিত্র, যা অন্তরঙ্গ ও হৃদয়গ্রাহী। ব্যক্তিগত অসংখ্য অভিজ্ঞতা এক সরস মন নিয়ে লেখার ফলে আদ্যন্ত সজীব এই বিবরণ। এ বই পড়ার শেষে পিৎজা বার্গার চাইনিজ তাইফুড মন থেকে সরে গিয়ে জলকাদাময় এই ভূখণ্ডে শস্যখেত, সাধারণ মানুষ আর প্রকৃতির দানে ভরে ওঠা খাদ্যসম্ভারের কথায় প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে বাংলা নামের চিরকালের এক দেশ। তাই মলাটে চিনেমাটির ডিশের উপর সাজানো কাঁটার সারি একটু বেমানান নয় কি? এ ছাড়া আছে মাহবুবুর রহমান চিত্রিত অজস্র স্কেচ, তাতে চর্চিত সারল্য ও কাল্পনিকতার যে কৌতুকময় প্রকাশ তা হয়তো অনেকেই উপভোগ করবেন।

Book Review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy