Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

সমাপতনের ভাগ একটু বেশি

ইবিস ট্রিলজির তিন নম্বর এবং দীর্ঘতম খণ্ড ফ্লাড অব ফায়ার প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে উনিশ শতকের আফিং-যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত এক আসমুদ্র আখ্যানের অবসান ঘটল, গল্পের সব তরীর যাত্রা শেষ হল প্রত্যাশা-পূরণের নিরাপদ বন্দরে। কিন্তু এই প্রত্যাশা-পূরণের প্রকৃত স্বরূপটি কি?

অভিজিৎ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০০:১২
Share: Save:

ইবিস ট্রিলজির তিন নম্বর এবং দীর্ঘতম খণ্ড ফ্লাড অব ফায়ার প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে উনিশ শতকের আফিং-যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত এক আসমুদ্র আখ্যানের অবসান ঘটল, গল্পের সব তরীর যাত্রা শেষ হল প্রত্যাশা-পূরণের নিরাপদ বন্দরে। কিন্তু এই প্রত্যাশা-পূরণের প্রকৃত স্বরূপটি কি? শুধুমাত্র মিলনান্তক আঙ্গিক বা এক সুমিমাংসীত পরিণতির পথে না হেঁটে লেখক এক কূট প্রস্তাবনা দাখিল করেছেন, যেখানে কাহিিনর প্রকৃত নায়ক হল পুঁজি ও উপনিবেশবাদের প্রধান চালিকাশক্তি ‘ফ্রি ট্রেড’। এই শব্দদ্বয় প্রায় মন্ত্রের মতো শোনা গেছে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে, যে মন্ত্রবলে মুক্ত বাণিজ্যের নামে নানাবিধ অনাচার বৈধতা লাভ করেছে, পাকাপোক্ত হয়েছে বণিকশ্রেিণ ও রাজন্যবর্গের আঁতাঁত।

উনিশ শতকের পাশ্চাত্য সাহিত্য আফিং-মৌতাতের এক রোম্যান্টিক মেদুরতায় আচ্ছন্ন, কিন্তু কী ভাবে এই পণ্য উৎপাদিত ও বাজারজাত হল সে বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। এই ট্রিলজির প্রথম খণ্ড সি অব পপিস উপন্যাসের অনেকাংশ জুড়ে আফিং-উৎপাদনের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা আমরা পেয়েছি, দ্বিতীয় খণ্ড রিভার অব স্মোক জুড়ে প্রথম আফিং যুদ্ধের তাল ঠোকা। তৃতীয় খণ্ডে এই পণ্যকে চিনের বাজারজাত করার রক্তক্ষয়ী বিবরণ। এই ইতিহাসে ভারতবর্ষ তথা কলকাতার ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্ত আমাদের আধুনিক ইতিহাসচেতনা আদ্যন্ত জাতীয়তাবাদী হওয়ার সুবাদে এই ইতিহাস আমাদের নজর এড়িয়ে থেকেছে এতদিন।

অমিতাভ ঘোষের এই উপন্যাস-ত্রয়ীর মানচিত্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক বিস্তৃত ভূখণ্ড ও জলভাগকে সংযুক্ত করেছে। লুকাচ তাঁর দ্য হিস্টোরিকাল নভেল (১৯৫৭) গ্রন্থে ঐতিহাসিক উপন্যাসের যে ধ্রুপদী বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেই শ্রেণিপরিচয়-চিহ্নিত বিন্যাসে হয়তো ইবিস ট্রিলজিকে পড়ে ফেলা যাবে না। একটি পণ্যের ইতিহাসকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা বারবার সম্মুখীন হই বিচিত্র ও জটিল সব মোড় ও সন্ধিক্ষণের, যা আমাদের একরৈখিক ইতিহাসচেতনার ভিত নাড়িয়ে দেয়। কিন্তু শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক থিসিস উপস্থাপনা করা তো কোনও উপন্যাসের প্রকল্প হতে পারে না, তার প্রধান দায়বদ্ধতা গল্প ও চরিত্রচিত্রায়ণের প্রতি। প্রথম খণ্ড সি অব পপিস-এ ইতিহাস ও গল্পের এক অসাধারণ ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছিলেন লেখক। তরঙ্গবিক্ষুব্ধ ‘ইবিস’-এর মতোই অনিশ্চয়তার দোলাচলে আন্দোলিত হয়েছিল দিতি ও মাধো, নীলরতন ও আহ ফাত, সারেং আলি ও জিকরি-মালুম।

দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথমেই কিন্তু এদের মধ্যে কেউ কেউ উপকথার জগতে ঢুকে গেল, যেমন দিতি ও মাধো। তাঁদের গল্পের নটে গাছ সেখানেই মুড়োলো। অন্য দিকে নীলরতন ও আহ ফাতের পুনর্জন্ম হল, নতুন নামের খোলসে। বস্তুত এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই কোনও না কোনও সময়ে নিজেকে পরিবর্তন করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে, বহু প্রজন্ম ধরে অনুশীলিত অভ্যাস, বৃত্তি ও সম্পর্ক ত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিচয় নির্বাচন করেছে। এই আত্মনির্মিতির প্রতিটি স্তরে লঙ্ঘিত হয়েছে নানাবিধ অনুশাসন। তাই পাঠকমাত্রেরই কৌতূহল ছিল প্রথম খণ্ডের অন্যতম চিত্তাকর্ষক চরিত্র জাকারি রিড বা জিকরি-মালুমকে নিয়ে। দ্বিতীয় খণ্ডে একটিমাত্র উল্লেখ ছাড়া ‘ইবিস’ জাহাজের এই নাবিক আগাগোড়াই অনুপস্থিত: এটুকুই শুধু জানানো হয় যে কলকাতায় ফিরে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ থেকে সে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিল।

কিন্তু তৃতীয় খণ্ডে যে জাকারি রিড ফিরে আসে, সে প্রথম খণ্ডের জিকরি-মালুমের এক ক্যারিকেচার মাত্র। আফিং-ব্যবসায়ী মিঃ বার্নহ্যামের বাড়িতে ছুতোরের চাকরি নেওয়ার পর মিসেস বার্নহ্যামের পাল্লায় পড়ে তাঁর যা অবস্থা হয়, তা কি আদৌ বিশ্বাস্য? একজন পোড়খাওয়া নাবিককে হস্তমৈথুনের কুফলের ভয় দেখিয়ে ক্রমশ বাগে আনার কষ্টকল্পিত এই অংশগুলি বই থেকে অনায়াসেই বাদ দেওয়া যেত। শুধু তাই নয়, জাকারি রিডের চরিত্রে যে আমূল পরিবর্তন ঘটে, তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা আমরা পাই না। দিতি ও মাধোকে বাদ দিলে কোনও নায়কোচিত চরিত্র এই উপন্যাসে নেই এবং এটি গ্রন্থকারের খুব সচেতন সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়। কিন্তু জাকারি রিডের ক্রমবর্ধমান অর্থলিপ্সা এবং উপন্যাসের শেষ লগ্নে ব্ল্যাকমেল করার প্রয়াস কি এক যুগাবসানের সংকেত বহন করে? এ প্রসঙ্গে বাবু নব কিসেনের সাশ্রু-নয়ন নির্ণয়: ‘that he should have been transformed so quickly from an ingenious, good-natured boy, into a perfect embodiment of the Kali-yuga, seemed… nothing less than a miracle’।

এ ছাড়া তৃতীয় খণ্ডে এসেছে দুজন আনকোরা নতুন চরিত্র, হাবিলদার কেশরী সিংহ ও তাঁর ঊর্ধ্বতন ক্যাপ্টেন মি। বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির এই দুই সৈন্যকে অনুসরণ করে এক সামরিক অভিযানের অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন লেখক। এই অভিযানের পরিণতি অবশ্যই ১৮৩৯-’৪২ সালের প্রথম আফিং-যুদ্ধ কিন্তু এই যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের বর্ণনা তৃতীয় খণ্ডের অন্যতম প্রাপ্তি। এই যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল ভারতীয় সিপাহিরা, বা বলা ভাল এক রকম লড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। সিপাহি বিদ্রোহের দু’দশক আগের এই বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাস উদ্ধার করতে গিয়ে লেখক পাঠকদের নিয়ে যান ছাউনি-জীবনের অন্তঃপুরে, যেখানে পল্টনদের সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটে দেহোপজীবিনী এবং ড্রাম ও ফাইফ-বাদক কিশোরদের দল, পরিভাষায় যাদের বলা হয় ‘ক্যাম্প ফলোয়ার’। অপ্রাপ্তবয়স্ক এই কিশোরদের যুদ্ধযাত্রা বিভীষিকার উদ্রেক করে, যেমন করে যুদ্ধযাত্রায় অনিচ্ছুক ভারতীয় সৈন্যদের কোর্ট-মার্শাল ও মৃত্যুদণ্ড প্রদান।

‘ইবিস’ জাহাজে বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রি যখন চিনা উপকূলে যাত্রা করে, একই সময়ে বোম্বাই বন্দর থেকে ‘হিন্দ’ জাহাজে একই গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হন প্রয়াত বাহরাম মোদী স্ত্রী শিরিন মোদী। অর্ধেক জীবন ঘরকন্না করার পর শিরিন মোদীর ঘর থেকে বাহিরে নিষ্ক্রমণ প্রকৃতই এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ; কিন্তু একই সঙ্গে লেখক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে বিত্তবান পার্সিদের সঙ্গে সঙ্গে আশাদিদির মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালিরাও একসময় কালাপানি পার হয়েছিলেন— ক্যান্টনে আশাদিদির খাবার দোকান বোধকরি আদি অকৃত্রিম দাদা-বৌদির হোটেল। ইতিহাসের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাদটীকার প্রতি অভিনিবেশ অমিতাভ ঘোষের কাহিনি-নির্মিতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এবং জিজ্ঞাসু পাঠকেরা এই উপাখ্যানগুলির মধ্যে খুঁজে পাবেন অপরাপর কাহিনির বীজ। উপন্যাসের শেষ পাদে ‘ইবিস’ জাহাজের ডেকেই সংঘটিত হয় কাহিনির সমস্ত দেনাপাওনা ও হিসেবনিকেশ। এই অংশে সমাপতনের ভাগটা একটু বেশিই পড়ে গেল বলে মনে হয়েছে। ইতিহাসের বেগবান প্রবাহের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ছোট ছোট কাহিনির স্রোতগুলি কি একই খাতে বয়ে গেল না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE