Advertisement
E-Paper

গণতন্ত্রের গুরুত্ব বুঝতে জরুরি

সে ছিল এক দিন যখন যৌথ পরিবারে সিদ্ধান্তগুলি নিতেন ঠাকুরদা কিংবা বড় জ্যাঠামশায়, সে রোববারের মাংসই হোক অথবা মেজখোকার মাস্টার। সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াটি ছিল অপেক্ষাকৃত সরল— ব্যক্তিবিশেষের (এ ক্ষেত্রে কর্তার) পছন্দই সমষ্টির সিদ্ধান্ত নির্ধারক।

অচিন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
মুখোমুখি: কেনেথ অ্যারো-র সোশ্যাল চয়েস অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ভ্যালুজ বইটি প্রকাশের ৬৫তম বার্ষিকীতে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এথিকস ইন সোসাইটি আয়োজিত আলোচনাসভায় অমর্ত্য সেন ও কেনেথ অ্যারো, ২০১৬। সৌজন্য: https://goo.gl/KlesqU

মুখোমুখি: কেনেথ অ্যারো-র সোশ্যাল চয়েস অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ভ্যালুজ বইটি প্রকাশের ৬৫তম বার্ষিকীতে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এথিকস ইন সোসাইটি আয়োজিত আলোচনাসভায় অমর্ত্য সেন ও কেনেথ অ্যারো, ২০১৬। সৌজন্য: https://goo.gl/KlesqU

কালেকটিভ চয়েস অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার

লেখক: অমর্ত্য সেন

মূল্য: ৫৯৯.০০

প্রকাশক: পেঙ্গুইন বুকস

সে ছিল এক দিন যখন যৌথ পরিবারে সিদ্ধান্তগুলি নিতেন ঠাকুরদা কিংবা বড় জ্যাঠামশায়, সে রোববারের মাংসই হোক অথবা মেজখোকার মাস্টার। সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াটি ছিল অপেক্ষাকৃত সরল— ব্যক্তিবিশেষের (এ ক্ষেত্রে কর্তার) পছন্দই সমষ্টির সিদ্ধান্ত নির্ধারক। পরিবারের কল্যাণের কথা ভেবেই কর্তা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন হয়তো, তবু প্রক্রিয়াটি একনায়কতান্ত্রিক। আমরা জানি গণতন্ত্রে এমনটা চলে না। সেখানে সমষ্টির প্রতিটি সদস্যের পছন্দ ও সুবিধার দিকটি সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ায় সমান জায়গা পাওয়ার কথা। আর সেখানেই জটিলতার শুরু। একদিকে পরিবারের কল্যাণের যুক্তিতে জ্যাঠামশায়ের অভিভাবকীয়তা বা প্যাটারনালিজম, অন্য দিকে ব্যক্তির স্বতন্ত্র পছন্দকে মান্যতা দেওয়া। এমন কোনও সিদ্ধান্তপদ্ধতি কি আছে যা কয়েকটি ন্যূনতম শর্ত মেনে চলবে আবার একনায়কতান্ত্রিকও হবে না? এই প্রশ্নটি বিশ্বের অনেক চিন্তাবিদকেই ভাবিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে একদল ফরাসি গণিতজ্ঞ গাণিতিক যুক্তি প্রয়োগ করে সমষ্টিগত চয়নের নানান সমস্যায় আলোকপাত করেছেন। যেমন কন্দরচে দেখালেন, মাত্র তিন ব্যক্তি তিনটি বিকল্পকে যদি নিজস্ব পছন্দমতো ক্রমাঙ্কে সাজায়, এমন হতেই পারে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিয়ম মেনে কোনও সামাজিক পছন্দ ক্রমাঙ্কে পৌঁছনো গেল না। এর নাম ‘কন্দরচে কূটাভাস’। বাস্তবেও দেখি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শেষমেশ হয়ে দাঁড়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দ ও মত অনুসারী। আবাসন-সমবায়ের সভায় দেখেছি পক্ষে ও বিপক্ষে তোলা হাত গুণে সিদ্ধান্ত নিতে। অথচ সংখ্যাগুরুর সিদ্ধান্তই যে সব দিক থেকে আদর্শ তা তো বলা যায় না। কেমন হবে যদি আমার প্রতিবেশীরা ভোটাভুটির মাধ্যমে ঠিক করেন আমাকে মাথা নিচে পা ওপরে তুলে খাড়া থাকতে হবে?

এইসব কূট প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়েই সামাজিক চয়ন তত্ত্বের জন্ম (পরিভাষায় সোশ্যাল চয়েস থিয়োরি)। এই তত্ত্বের আধুনিক সংস্করণের শুরু নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো-র হাতে ১৯৫০ নাগাদ। যে উপপাদ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে অ্যারো হইচই ফেলে দেন তা অবশ্য নিতান্তই নৈরাশ্যমূলক। আঁটসাট যুক্তি দিয়ে তিনি দেখালেন, শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক পদ্ধতিই নয়, এমন কোনও সামাজিক চয়ন পদ্ধতিই নেই যা ন্যূনতম চারটি শর্তের একটিকেও লঙ্ঘন না করে। শর্তগুলিও আপাতদৃষ্টিতে অতীব নিরীহ এবং যুক্তিমান্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর মানুষ যখন শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে তখনই চিন্তার জগৎকে নাড়িয়ে দিল অ্যারোর এই অসম্ভাব্যতা উপপাদ্যর বোমা। তারপর দুই দশক চলল একে নিয়ে কাটাছেঁড়া— অসম্ভাব্যতা থেকে যদি কোনও সম্ভাবনার আলো দেখা যায়। অ্যারোর পরেই এই চর্চাক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে গভীর ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি অমর্ত্য সেন। নোবেল কমিটির শংসাপত্রেও অর্থনীতিতে তাঁর অবদানের প্রসঙ্গে সামাজিক চয়ন ক্ষেত্রকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে দেখা গিয়েছে। ১৯৭০-এ প্রকাশিত তাঁর কালেক্টিভ চয়েস অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বইটি জ্ঞানচর্চার এই বিশেষ শাখায় মাইলফলকবিশেষ। সাড়ে চার দশক পরে তিনি যে সেটির সংস্করণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন এবং প্রায় দ্বিগুণ কলেবরে গ্রন্থটি পুনর্জন্ম নিল, সমাজবিজ্ঞানের জগতে এ মামুলি ঘটনা নয়।

সামাজিক চয়ন বিষয়টি যদিও রাষ্ট্রচালনা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কিছু প্রাথমিক সমস্যা থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল আদিতে, পরবর্তী কালে গণিত আর সূক্ষ্ম যুক্তির অনুশীলন ক্ষেত্র হিসেবে তা মূলত অর্থনীতিবিদদের আকর্ষণের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। ফলত অতিমাত্রায় গণিতমনস্ক বিমূর্ত চিন্তায় আগ্রহী অর্থনীতির ছাত্র ছাড়া সমাজবিজ্ঞানের অন্য শাখার জ্ঞানপিপাসুরা উপপাদ্য-প্রমাণ-সঙ্কুল সেই বন্ধুর পথে পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন বা আগ্রহ কোনওটাই বোধ করেননি। অথচ তা হওয়ার কথা ছিল না। সামাজিক চয়ন তত্ত্বের গভীর অর্থবহ নানান তাত্ত্বিক যুক্তিকাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সমাজ-সংগঠন থেকে ন্যায়ের দর্শনের অনেক প্রশ্ন যার গুরুত্ব যে কোনও চিন্তাশীল সচেতন মানুষের কাছেই অপরিসীম। অমর্ত্য সেনও কখনও চাননি বিষয়টি কতিপয় বিশেষজ্ঞর গাণিতিক মুগুর ভাঁজার ক্ষেত্র হিসেবে আটকে থাকুক। বিগত পাঁচ দশকের ওপর তিনি যে কাজটি পরম একাগ্রতায় করে গিয়েছেন তা চমকপ্রদ। একদিকে সামাজিক চয়নকে নঞর্থক পরিণতির নৈরাশ্য থেকে বা’র করে সম্ভাব্যতার দিকে নিয়ে যাওয়ার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন; অন্য দিকে দারিদ্র, অপুষ্টি, অশিক্ষা, অকালমৃত্যু ইত্যাদি গুরুতর বিষয় নিয়ে নীতিচিন্তাকে ন্যায্যতার জোরালো ভিত্তিতে স্থাপন করেছেন। এই দু’ধরনের কর্মকাণ্ড আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও তারা একই চিন্তাসূত্রে গ্রথিত। অসম্ভাব্যতা উপপাদ্য আসলে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষীণ তথ্য-ভিত্তির ওপর নির্ভরতার কারণে। ব্যক্তির পছন্দক্রমাঙ্ক থেকে সমষ্টির পছন্দক্রমাঙ্ক নির্ণয়ে আর কোনও তথ্য এখানে প্রাসঙ্গিক বলে ধরা হচ্ছে না, তাই অসম্ভাব্যতা। বাস্তবে কিন্তু বিকল্পগুলিকে কী ভাবে মূল্যায়ন করবে সমাজ, কী ভাবে ক্রমান্বয়ে সাজাবে, তার হরেক উপায় আছে। যেমন, দুটি সামাজিক অবস্থার মধ্যে দরিদ্রতম মানুষটি কোনটিতে খারাপ আছেন তার ভিত্তিতেও অবস্থাগুলি ক্রমাঙ্কে সাজানো যায়। সে ক্ষেত্রে অ্যারোর পছন্দকেন্দ্রিক যুক্তিকাঠামো ছেড়ে মূল্যায়নকেন্দ্রিক যুক্তিকাঠামোয় ঢুকতে হবে। এই মূল্যায়নে ‘ক’ ব্যক্তির অবস্থার সঙ্গে ‘খ’ ব্যক্তির অবস্থার তুলনা সম্ভব ধরে নিয়ে এগোতে হবে। ব্যক্তিগত পছন্দভিত্তিক অ্যারোর সিস্টেমে এই পূর্বধারণার প্রয়োজন নেই। এই মূল্যায়নভিত্তিক সামাজিক চয়নের পরিকাঠামো নিয়ে তত্ত্বভাবনাই অমর্ত্য সেনের রচনার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে। যে মূল দ্বন্দ্বের তাঁকে সর্বদাই মোকাবিলা করে যেতে হয়েছে তা হল এক দিকে বিশুদ্ধ ব্যক্তিস্বাধীনতার দর্শন, যা অ্যারো সিস্টেমের পটভূমি, আর অন্য দিকে অভিভাবকীয়তার অস্বস্তিকর দিকগুলি। দ্বন্দ্বের নিরসনে তিনি গণপরিসরে আলোচনা, যুক্তিতর্ক, সমষ্টির বিচারশীলতায় জোর দিয়েছেন। আর জোর দিয়েছেন আমাদের অবস্থানসঞ্জাত দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের প্রয়োজনীয়তার দিকে। গণতন্ত্রকে পাকাপোক্ত ভিত্তিতে খাড়া করতে গেলে এগুলি অপরিহার্য। নবসংযোজিত অধ্যায়ের একটির শিরোনামই ‘ডেমক্রেসি অ্যান্ড পাবলিক এনগেজমেন্‌ট’। সেখানে লেখক গণতন্ত্র নিয়ে দুটি দৃষ্টিভঙ্গিকে চিহ্নিত করেছেন। একটি নির্বাচনপ্রক্রিয়ার ভালমন্দ নিয়ে— তথাকথিত অবাধ এবং সমদর্শী নির্বাচনই যেন শেষ কথা। আর অন্যটি গণতন্ত্রের মর্মবস্তু ঘিরে, যেখানে প্রকাশ্য যুক্তিপ্রয়োগের ওপর জোর দিচ্ছেন বারবার, যেখানে গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী শুধুমাত্র গরিষ্ঠের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ ভেবেই ভোটটা দেবে না।

অর্ধ শতক ধরে ধারাবাহিক ভাবে ন্যায়ের দর্শনের বুনিয়াদি ধারণাগুলি— যেমন স্বাধীনতা, মানবকল্যাণ, স্ব-ক্ষমতা, সাম্য, অধিকার, ন্যায্যতা, ইত্যাদিকে সামাজিক চয়নের যুক্তিকাঠামোয় ফেলে এমন এক মহীরুহ সৃষ্টি করেছেন অমর্ত্য সেন যা তুলনারহিত। এ বই যুক্তিবিদ্যার পাঠ্যপুস্তক নয়, কিন্তু বইটি পড়া থাকলে গণতন্ত্রের প্রকৃতি ও তার গুরুত্ব বোঝার কাজটি সহজ হয়, যুক্তিবিচারবোধে শান পড়ে। আবাসন-সমবায়ের সভায় বা সান্ধ্য টিভি বিতর্কের মান-এ যার প্রতিফলন ঘটবেই।

Kenneth Arrow Democracy Amartya Sen Collective Choice and Social Welfare
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy