Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

শিল্পের ইতিহাসে স্বতন্ত্র

সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সত্যজিৎ, আর লিখেছিলেন ‘তার প্রতি আমার নির্ভরশীলতা আমার শিল্পীজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় থাকবে...।’

নির্ভর: ‘সোনার কেল্লা’ শুটিংয়ের সময় জয়শলমির স্টেশনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়। ছবি সন্দীপ রায়

নির্ভর: ‘সোনার কেল্লা’ শুটিংয়ের সময় জয়শলমির স্টেশনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়। ছবি সন্দীপ রায়

শিলাদিত্য সেন
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

গদ্যসংগ্রহ ১-২/ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সম্পাদক: রঞ্জন মিত্র ও শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়

মূল্য: ১২০০.০০ (দুই খণ্ড)

প্রকাশক: দে’জ পাবলিশিং

অশনি সংকেত-এর শুটিংয়ের আগেই বীরভূমের গ্রামে হাজির হয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। সেখানকার মানুষজন আর তাদের জীবনযাপন দেখার ইচ্ছে নিয়ে। সত্যজিৎ গিয়েছিলেন নিজের অভ্যাসবশত লোকেশন খুঁটিয়ে দেখতে, আর সৌমিত্র নিজের নোটবুকে নানা ধরনের নোট্‌স্ নিচ্ছিলেন... গ্রামের লোকের কমন ম্যানারিজম, কী ভাবে গা চুলকোয়, হাঁটে, কাঁধে গামছা রাখে, উবু হয়ে বসে ইত্যাদি। সঙ্গে নিজের কিছু চিন্তাভাবনাও লিখে রাখছিলেন। এ থেকে একজন অভিনেতার কর্মপদ্ধতি যেমন বেরিয়ে আসে, তেমন তাঁর মানসিকতাও।

যেমন লোকেশন দেখার সময় লিখছেন ‘অদ্ভুত সব গ্রাম— সুন্দর...’, আবার পরে যখন শুটিং করতে যাচ্ছেন, লিখছেন ‘সামনে অনাহার। এই কোমল শ্যামল নিস্তরঙ্গতার মধ্যে মৃত্যুর পদসঞ্চার শোনা যায়। আমার চৈতন্য আমার মুখ চোখ সেকথা যেন ধরতে পারে।’ আরও আগের নোট্‌স্-এ লিখেছেন, গঙ্গাচরণ চরিত্রে ‘একটা অদ্ভুত সংমিশ্রণ করতে হবে অভিব্যক্তিতে সরলতার সঙ্গে একটু ধূর্তোমির। যে ধূর্তোমিটা তার জীবনসংগ্রাম তাকে শিখিয়েছে। তার পেশা যজমানি... এই পেশায় সে তার থেকেও সরল সংস্কারসম্পন্ন চাষাভূষোকে ঠকিয়ে খায়।’ এর পর গঙ্গাচরণ সম্পর্কে তাঁর ভয়ংকর উপলব্ধি ‘ইতিহাস এই নগণ্য পুরুতটিকে তার চারিপাশ-সমেত এমন একটা জায়গায় ক্রমে এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে যেখানে তার ওইটুকু জারিজুরি আর খাটছে না। সে এঁটে উঠতে পারছে না জীবনসংগ্রামে তার থেকে কোটিগুণ শক্তিশালী শত্রুকে— দুর্ভিক্ষকে।’

পড়তে-পড়তে মনে হয় উপনিবেশের কালে জন্মানো সৌমিত্র (জ. ১৯৩৫) আমাদের পরাধীন অস্তিত্বের ভিতর সঞ্চারিত স্বদেশ জিজ্ঞাসার কোনও পাঠ তৈরি করছেন। অশনি সংকেত-এর শুটিং শেষ করে যখন ফিরছেন, তখন তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে ‘এই এতদিনে শারীরিকভাবে মানসিকভাবে গঙ্গাচরণের জন্য যেন পুরোপুরি তৈরি হতে পেরেছি।... অথচ ঠিক এখনই শেষ হয়ে গেল অভিনয়।’

সৌমিত্রের এই মনন, নিরন্তর অতৃপ্তিই তাঁকে সত্যজিতের সারাজীবনের সঙ্গী করে তুলেছিল। ‘সৌমিত্র নিজের থেকেই বুঝতে পারত, আমি কী চাই।’ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সত্যজিৎ, আর লিখেছিলেন ‘তার প্রতি আমার নির্ভরশীলতা আমার শিল্পীজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় থাকবে...।’ উল্টোদিকে সৌমিত্র লিখেছেন ‘সারাজীবনে মানিকদার ছবিতে আমি প্রাণ খুলে যথেষ্ট স্বাধীনতা নিয়ে অভিনয় করতে পেরেছি... স্বাধীনতা গ্রহণ করার যে আত্মবিশ্বাস তা ওঁর কাছেই পেয়েছি।’ অপু হয়ে-ওঠার জন্য সৌমিত্রকে ‘অপুর সংসার’-এর চিত্রনাট্য দিয়েছিলেন সত্যজিৎ, এর আগে তিনি কোনও অভিনেতাকে চিত্রনাট্য দিতেন না, সঙ্গে দু’টি ফুলস্ক্যাপ পাতায় লিখে দিয়েছিলেন অপু চরিত্রটিকে নিয়ে নানা দৃষ্টিকোণে দেখা নিজস্ব ভাবনা। পাশাপাশি সৌমিত্রও লিখেছিলেন ‘অপু-র ডায়েরি’, অপু সম্পর্কিত নিজের অভিজ্ঞতায় ভর-করা কল্পনা। আজও যখন সে-ছবি তৈরির স্মৃতিতে ফেরেন সৌমিত্র, লেখেন ‘বাস্তবতাকে মাপকাঠি করে অভিনয়ের ওই যে চেষ্টা ওটাই অভিনয়ের আসল অভিপ্রায়।’

সত্যজিতের কাছে আসার আগে যখন অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রস্তুতির ভিত তৈরি করছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর কাছে, তিনি বলেছিলেন ‘যখন পড়বে তখন গোয়েন্দার মতো পড়বে...’, শিক্ষার্থী সৌমিত্র কখনও ভোলেন না সে কথা, ‘গোয়েন্দার মতো খোঁজা আজও আমার ধ্রুবমন্ত্র হয়ে আছে।’ সৌমিত্রর এই শিল্প-অভিপ্রায়ই তাঁর দু’খণ্ডের বিপুল গদ্যসংগ্রহ-এ বিবিধ বিষয়ে বিন্যস্ত। তাঁর গদ্যের ধীশক্তি ও লাবণ্যপ্রভা প্রমাণ দেয় যে বাংলা ভাষার প্রতি কতখানি নিষ্ঠ তিনি। ভূমিকা-য় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল্যায়ন, এ সংগ্রহ ‘একজন নিষ্ঠাবান নিয়োজিতপ্রাণ জাত অভিনেতার আজীবন অভিনয়চর্চার পরম মূল্যবান ও শিক্ষণীয়’ দলিল— ‘পরিতৃপ্তি তথা আত্মশ্লাঘা’র পরিবর্তে ‘স্বতন্ত্র এই স্বর’।

সৌমিত্রর স্বতন্ত্র এই স্বরের মূলে তাঁর আজীবনের সাজাত্যবোধ। যখন নাটক রচনা করছেন, তা ‘সমকালের জীবনযন্ত্রণার অনুভবে’ বুনছেন, কারণ হিসেবে জানাচ্ছেন ‘যা সমসময়ের স্বদেশের ক্ষেত্রেও সত্য বলে প্রত্যয় হয় সেইটাকেই রাখার চেষ্টা...।’ একই কারণ তাঁর রবীন্দ্রনাথ-চর্চার ক্ষেত্রেও, ‘আজকের এই ছিন্নভিন্ন কর্তিত কুরুযুদ্ধের মতো কালে... আমাকে ন্যায়-অন্যায়ের হিত-অহিতের জ্ঞানে স্থিত রাখতে পারে, শুভকর্মে মানবমুক্তির পথে চালিত করতে পারে।’ তাঁর এই গদ্যাদির একটি বাক্যাংশই যেন সত্য হয়ে ওঠে নাটক-গদ্যের পাশাপাশি তাঁর কবিতা বা ছবি আঁকাতেও, ‘অস্পষ্ট হ’লেও কোনো প্রচ্ছন্ন ইতিহাসের ক্ষীণ পদচিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়’ সেখানে। দীর্ঘ ষাট বছরে উপনীত তাঁর অভিনয় জীবনেও, সেখানে অভিনীত চরিত্রগুলিতেও প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে ইতিহাসের স্বর, যে ইতিহাস বড় বিষাদময়, দেশকালের বিষণ্ণতা লেগে থাকে তাতে।

কলাকৌশলের ওপরই অভিনয়ের নির্ভর, কিন্তু একজন অভিনেতা শিল্পী হয়ে ওঠেন তখনই যখন তিনি মননসঞ্জাত বীক্ষায় বা দর্শনে চরিত্রটির ভিতর বুনতে পারেন সৃজনের কল্পনা আর প্রায়োগিকতার দুই প্রান্ত। অভিনয়চর্চার ক্ষেত্রে সৌমিত্র তাঁর নিজস্বতার বৈশিষ্ট্যকে শিল্পকর্মের মৌলিকতার সঙ্গে এমনই মিশিয়ে নিতে পেরেছেন যে শিল্পের ইতিহাসে তিনি স্বতন্ত্র এবং অনিবার্য। এ দেশে এখন ভাল অভিনেতা অনেকেই আছেন, ছিলেনও, কিন্তু তাঁর মতো শিল্পী কেউ নেই, হবেনও না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE