Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Amiya P Sen

পাঠ শুরুর পথটুকু খুঁজে নেওয়া যায়

অমিয় পি সেন তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, এক ‘মহিলা’-র কাছ থেকে ভাল চাল আনার জন্য, চৈতন্য তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপই বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

মগ্ন: নামসঙ্কীর্তনরত শ্রীচৈতন্য। শিল্পী যামিনী রায়

মগ্ন: নামসঙ্কীর্তনরত শ্রীচৈতন্য। শিল্পী যামিনী রায়

অলখ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:১১
Share: Save:

চৈতন্যের চরিতকথাগুলোতে মিলেমিশেই রয়েছে অনৃত এবং অমৃত। চরিতকাব্য যে কাব্যই। কাব্যকাররা চরিত্র ও কাহিনি নির্মাণে সাহিত্য প্রকরণগুলোকে রচনার উপকরণ বলেই ব্যবহার করেন। কখনও অস্ত্র হিসেবেও। চরিতকাব্যকারদের পরিচয় ও সময়কাল তাই তখনও যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখনও রয়েছে। এখনও সমকালের সঙ্গে চৈতন্যজীবনকালের একটি সন্ধি করতে হয় জীবনীকারকে। আর সে কাজ খুব সহজ নয়। তার একটি বড় কারণ, যাঁর জীবন নিয়ে এই ভাবনা, তিনিও সাহিত্য প্রকরণে পটু শুধু নন, অত্যন্ত সমাদরের সঙ্গে জীবনে তা ব্যবহারও করেছেন। তিনি গীত, নৃত্য, কাব্য, নাটক ও তার নানা প্রকাশকে জীবনের স্বাভাবিক অঙ্গে পরিণত করে দিতে পারেন। দৈনন্দিনের আচরণে তুলে আনতে পারেন সেই প্রকাশ। আবার, একই সঙ্গে, তাঁর আচরণে পরস্পরবিরোধিতাও যে কখনও কখনও খুবই প্রকট। তার ব্যাখ্যা চরিতকাররা নিজেদের মতো করে দিয়েছেন। জীবনীকারকে সেই জট সমকালের সঙ্গে সন্ধি করেই ছাড়াতে হয়।

যেমন, অমিয় পি সেন তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, এক ‘মহিলা’-র কাছ থেকে ভাল চাল আনার জন্য, চৈতন্য তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, ছোট হরিদাসের মতো অনুরক্ত ভক্ত প্রয়াগে গিয়ে আত্মবিসর্জন দেন।

কিন্তু এর মধ্যে আরও কিছু কথা রয়ে যায়। যে চৈতন্য সনাতনকে কৃষ্ণের বাঁশির ধ্বনির কথা বলতে গিয়ে বলছেন, ‘‘ধ্বনি বড় উদ্ধত পতিব্রতার ভাঙে ব্রত / পতিকোল হইতে টানি আনে।’’ সেই চৈতন্য সত্যিই এক বার যমেশ্বর টোটা যাওয়ার পথে এক দেবদাসীর কণ্ঠে গুর্জরী রাগে গীতগোবিন্দের পদ শুনে তিনি ‘স্ত্রী-পুরুষ কে গায় না জানি বিশেষ’ ছুটে চললেন। গায়ে কাঁটা ফুটল, তবু ঘোর ভাঙল না। শেষ পর্যন্ত গোবিন্দ তাঁকে কোলে তুলে নিবৃত্ত করেন। তখন চৈতন্য বলেছিলেন, ‘‘গোবিন্দ আজি রাখিলে জীবন। স্ত্রী-পরশ হৈলে আমার হইত মরণ।’’ এ কথা চৈতন্য বার বার বলেছেন। কিন্তু এই মনোভাবের সঙ্গে মেলে না এমনও কিছু ঘটনা রয়েছে। অমিয়বাবু যে চৈতন্যচরিতকারের উপরে খুবই নির্ভর করেছেন, সেই স্বয়ং কবি কর্ণপুরের জন্মবৃত্তান্তই যে কারণে বেশ আশ্চর্যের। কর্ণপুরের বাবা শিবানন্দ সেন চৈতন্যের খুবই প্রিয় ছিলেন। গৌড়ীয় ভক্তরা চৈতন্যের সঙ্গে দেখা করতে পুরীতে গেলে সাধারণত চাতুর্মাস্য পালন করতেন। সেই গমনাগমনের ব্যবস্থা করতেন শিবানন্দ। এই চাতুর্মাস্যের সময়, সন্ন্যাসী বা অবধূত না হলেও, খুব কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করতে হত। কিন্তু একবার পুরীতে বাসকালেই শিবানন্দের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হন। চৈতন্য অথচ নিরুত্তাপ। বরং বৃন্দাবনদাসের কথায়, শিবানন্দের পুত্রের নামকরণও করেছিলেন। শিবানন্দকে বলেন, ‘‘এবার তোমার যেই হইবে কুমার। পুরীদাস বলি নাম ধরিহ তাহার।।’’ কৃষ্ণদাস কবিরাজও কিছু কথা অবিকল বিবৃত করেছেন, কিছু সম্পাদনা করেছেন। তবে দুই চরিতকাব্যকারই মুখরক্ষার মতো করে জানিয়েছেন, চৈতন্য শিবানন্দকে উপহাস করেছিলেন। কিন্তু শিবানন্দ চৈতন্যর ঘনিষ্ঠ বৃত্তেই রয়ে গেলেন। তা হলে, পরম ভক্ত ছোট হরিদাসের ক্ষেত্রে এত প্রচণ্ড কঠোরতা কেন?

চৈতন্য/ আ লাইফ অ্যান্ড লেগ্যাসি
অমিয় পি সেন
৭৯৫.০০
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

চৈতন্যের জীবনীকার খেয়াল করতে পারেন, যে ‘মহিলা’-র কাছ থেকে অন্ন নিয়ে এসেছিলেন ছোট হরিদাস, সেই মাধবী মাহিতীর দাদা শিখি ছিলেন বাসুদেব সার্বভৌমের ঘনিষ্ঠ। ভাই মুরারি, বোন মাধবীর সঙ্গে শিখি থাকতেন পুরীতে। জগন্নাথ মন্দিরের ইতিহাস লিখতেন। চৈতন্য পুরী যাওয়ার পরে ভাইবোনকে সঙ্গে নিয়ে বাসুদেব সার্বভৌমের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন শিখি। মুরারি ও মাধবী চৈতন্যকে দেখে স্বয়ং কৃষ্ণ বলে সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে নেন। কিন্তু বাসুদেব ঘনিষ্ঠ শিখি চৈতন্যকে ভগবান বলে মানতে চাননি। ঠিক এই সময় চৈতন্য সম্পর্কে বাসুদেবের মনোভাবে দোলাচল রয়েছে। তাঁদের প্রাথমিক বিরূপতা বেশ তিক্ত ছিল। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে চৈতন্য সম্পর্কে বাসুদেব বলেছেন, ‘‘আমার সনে বিবাদ করিলে চিড়ি পো। নীলাচল হইতে বাহির কর‌্যা থো।।’’ এমনকি, ‘‘চক্রবেড় প্রবেশিতে বেত্র মার শিরে।’’ মাধবী হলেন সেই বাসুদেবের ঘনিষ্ঠ শিখির বোন। কিছু পরেই চৈতন্যের প্রতাপের প্রভাব বাড়ল। বাসুদেব এর পরে চৈতন্যকে স্বতন্ত্র ঈশ্বর বলেছেন, শিখিও এক দিন কান্নায় ভেসে গেলেন। এই হল, বিখ্যাত পঞ্চম পুরুষার্থ। যা মোক্ষ-রও উপরে। যে পঞ্চম পুরুষার্থের কথা পরে বিস্তারিত ভাবে বলেছেন স্বয়ং শ্রীরূপ গোস্বামী।

এ বার সমকালের সঙ্গে সন্ধি করে জীবনীকার খেয়াল করতে পারেন, উজ্জ্বল নীলমণি-র পঞ্চম পুরুষার্থ কৃষ্ণদাস কবিরাজের জানা ছিল, তিনি তাই আরোপ করলেন শিখির উপরে। কিন্তু, মুরারি ও মাধবীর পক্ষে পঞ্চম পুরুষার্থ অবস্থার কথা জানারই কথা নয়।

চৈতন্য জীবনীকার সেই সঙ্গে খেয়াল করতে পারেন, ছোট হরিদাসকে ক্ষমা করার জন্য পরিকররা চৈতন্যকে সানুনয়ে বার বার বলেছিলেন, ‘‘অল্প অপরাধ প্রভু করহ প্রসাদ।’’ চৈতন্য অটলই রইলেন। হরিদাসের অবস্থা ‘‘দেখি ত্রাস উপজিল সব ভক্তগণে।’’ যিনি নিজে তরুর চেয়ে সহিষ্ণু হতে বলেছেন, তাঁকে কেন সকলে ভয় পেতেন, সে প্রসঙ্গ না হয় তোলা থাক। যেমন তোলা থাক, দ্বার মানা হরিদাসের মৃত্যুর পরে কেন কৃষ্ণদাসকে এই কাহিনি বলতে হচ্ছে যে, ছোট হরিদাস ‘‘ত্রিবেণী প্রবেশ করি প্রাণ ছাড়িল। সেইক্ষণে প্রভু-স্থানে দিব্যদেহে আইলা।। প্রভু-কৃপা পাঞা অন্তর্ধানে রহিলা। রাত্র্যে প্রভুরে শুনায় অন্যে নাহি জানে।।’’ এই কাহিনিটি কি তাঁর সমকালের সঙ্গে কৃষ্ণদাসের সন্ধির কাহিনিও, যেখানে তিনি বলতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘অন্যে নাহি জানে’ অবস্থাটিও রইল না, সমুদ্রতীরে অশরীরী হরিদাসের কণ্ঠে গান শুনেছিলেন স্বরূপ দামোদর, গোবিন্দরাও— ‘‘আকারে না দেখি মাত্র শুনি তার গান।’’

যবন হরিদাসের ক্ষেত্রেও অমিয়বাবু খুবই সংযত। তিনি শুধু বলছেন, চৈতন্যের ‘নির্দেশে’ হরিদাসকে পুরীর সমুদ্র সৈকতে সমাধি দেওয়া হয়। কিন্তু সমকালের সঙ্গে সন্ধির যে কথা বার বার উঠছে, তাতে এটুকুও তিনি পাঠককে বলতে পারতেন, শুধু নির্দেশ দিয়ে ক্ষান্ত হননি চৈতন্য। মৃত্যুর পরে যবন ‘‘হরিদাসের তনু প্রভু কোলে উঠাইয়া। অঙ্গনে নাচেন প্রভু প্রেমাবিষ্ট হঞা।।’’ বলতে পারতেন, চৈতন্য— ‘‘হরিদাসে সমুদ্রজলে স্নান করাইল। ...বালুকার গর্ত করি তাহে শোয়াইল। ...আপনি শ্রীহস্তে বালু দিল তার গায়।।’’ যবন হরিদাসকে তিনি ‘স্বতন্ত্র কৃষ্ণ’ বলে ডাকছেন। আর তার পরে এক প্রাণকাড়া হাহাকার—‘‘হরিদাসের ইচ্ছা যবে হইল চলিতে। আমার শকতি তারে রাখিল নারিতে।।’’ এই চৈতন্যই কি ছোট হরিদাসকে শাস্তি দিয়েছেন? এই চৈতন্য কেবল সংগঠক নন। তিনি সেই একান্ত যাত্রা এ বার শুরু করেছেন। যে যাত্রায় নিজের জন্য নিজে পথ তৈরি করেছেন। এই পথ তৈরির পথটি সমকালের জীবনীকারের খোঁজ হতে পারে। কারণ তাঁর যে সাহিত্য প্রকরণের জট ছাড়িয়ে ব্যাখ্যা করার দায় রয়েছে, ‘আমার শকতি’ আস্থার ইঙ্গিত না দীনতার!

অমিয়বাবু প্রধানত সেই পাঠকদের জন্য লিখেছেন, যাঁরা বাংলা জানেন না। সম্ভবত সে কারণেই তিনি চৈতন্য-অভিঘাতের চরিত্রের চেয়ে তার চিত্রের প্রতি বেশি মনোযোগী। আর তাতে রয়ে যাওয়া কথা রয়েই যায়।

সব কথা ছুঁয়ে যাওয়ার তাগিদে তিনি চৈতন্য পরিকরদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় যোগ করেছেন, তাঁদের জীবনীগ্রন্থগুলোর তালিকা দিয়েছেন, চৈতন্য ও নিত্যানন্দের মন্দিরগুলোরও একটি তালিকা রয়েছে, এমনকি, উনিশ শতকে চৈতন্যকে কী ভাবে দেখা হয়েছিল, তা নিয়েও আলোচনা করেছেন। তাই বইটি এমন একটি চৈতন্য পরিক্রমা, যেখানে পাঠ শুরুর পথটুকু, লেখকের সঙ্গে দ্বিমত হলেও, নিশ্চয়ই খুঁজে নেওয়া যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Amiya P Sen Book .Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE