যে সিমোন দ্য বোভোয়াকে আমরা চিনি, তিনি নারীবাদী তাত্ত্বিক। বিশ্ব জুড়ে তাঁর খ্যাতি দ্য সেকেন্ড সেক্স বইটা লেখার জন্য, যেটা ছাড়া নারীবাদের পাঠ সম্পূর্ণ হয় না কখনও। অথবা, নারীবাদের পাঠ অনায়াসে শুরু করা যায় যে বইটা দিয়ে। আসলে যেমন হওয়া উচিত, আমরা বোধ হয় তেমন করেই পড়েছি বোভোয়াকে। তত্ত্বের নির্লিপ্তি নিয়ে। ক্লাসঘরে, সেমিনারে, আলোচনাচক্রে, প্রবন্ধের পাতায় তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি বার বার। বিশ শতকের নারীবাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন সিমোন দ্য বোভোয়া।
অথচ ভেবে দেখতে গেলে, একটা মানুষের মধ্যে তো আরও কতকগুলো মানুষ থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই। উপরের স্পষ্ট যে আবরণ— সমাজ, রাজনীতি অথবা তত্ত্বকথার যে বাইরের মোড়কটা— সেটার মধ্যেই বেশির ভাগ সময় আমরা গোটা মানুষটাকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি। পড়ে ফেলতে চেষ্টা করি তাঁর দর্শন, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের স্তরগুলি। বোভোয়ার ক্ষেত্রেও হয়তো ব্যাপারটা খানিক সে রকম ঘটেছে। প্রতিবাদের বিজ্ঞাপনের মডেল হতে হতে ভিতরের অন্য মানুষগুলো ক্রমাগত সরে সরে গিয়েছে আমাদের কাছ থেকে। এ কথা আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের মনে করিয়ে দিই বার বার। খানিকটা সাহস করেই। পড়তে বলি সার্ত্রকে লেখা বোভোয়ার চিঠিগুলো। নিখাদ প্রেমের আর যন্ত্রণার চিঠি। সব সময় আমাদের চেনা বোভোয়ার সঙ্গে মেলানো যায় না।
কয়েক বছর পর এই বন্দিদশায় ফিরে পড়লাম বোভোয়ার আর একটা অল্প চেনা বই। মায়ের মৃত্যু দেখছেন কাছ থেকে। সিমোন আর তাঁর বোন পুপেঁ। হাসপাতাল শুয়ে রয়েছেন মা। চিকিৎসা চলছে। গিয়েছিলেন ছোট একটা অস্ত্রোপচার করানোর জন্য। ধরা পড়ল কর্কটরোগ। মা জানেননি সে কথা। দুই বোন রোজ পাহারা দেন মা-কে। পালা করে। এক জন দিনে, এক জন রাতে। কথা বলেন, ওষুধ খাওয়ান, পিছনে বালিশ দিয়ে মা-কে বসিয়ে চামচে করে সুপ খাইয়ে দেন। পাশে বসে বই পড়েন। ফুল এনে সাজিয়ে রাখেন মায়ের শয্যার পাশে। ঘরের বাইরে গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে নিচু গলায় আলোচনা সেরে নেন। ভেঙে পড়েন বার বার। একশো পাতার কিছু কম, শীর্ণ একটা স্মৃতিচারণ: আ ভেরি ইজ়ি ডেথ।