Advertisement
২২ মে ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২: বাংলাদেশের বই

বাঙালির ঐতিহ্য ও স্বরূপ-সন্ধান

বাহান্নর ভাষা-আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী আহ্‌মদ রফিক। তিনি গবেষক, রবীন্দ্রপ্রেমিক এবং প্রাবন্ধিক। ভাষা-আন্দোলনের সময় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন তিনি। পরে আন্দোলন এবং তার অভিজ্ঞতা ও তাৎপর্য নিয়ে গ্রন্থ লিখেছেন।

একুশের দিনলিপি। আহ্‌মদ রফিক। মধ্যমা, ৩৭৫.০০

একুশের দিনলিপি। আহ্‌মদ রফিক। মধ্যমা, ৩৭৫.০০

আবুল হাসনাত
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

বাহান্নর ভাষা-আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী আহ্‌মদ রফিক। তিনি গবেষক, রবীন্দ্রপ্রেমিক এবং প্রাবন্ধিক। ভাষা-আন্দোলনের সময় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন তিনি। পরে আন্দোলন এবং তার অভিজ্ঞতা ও তাৎপর্য নিয়ে গ্রন্থ লিখেছেন। ভাষা-আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণে বৃহৎ ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা-চেতনা দ্বিজাতিতত্ত্বের আদর্শকে ছিন্ন করে বাঙালির স্বরূপ ও ঐতিহ্য-চেতনায় নবীন মাত্রা সঞ্চার করেছে। এই চেতনাকে ধারণ করেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভাষা-আন্দোলনের চেতনাছায়ায় দীপিত হয়ে এ দেশের সাহিত্য ও শিল্পের বিষয় ও প্রকরণও পালটে যায়। প্রথাশাসিত সমাজ যুক্তি, জিজ্ঞাসা ও ঐতিহ্যের আলোকে বিবর্তিত হতে থাকে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনও এই চেতনায় স্নাত হয়।

একুশের দিনলিপি গ্রন্থে আহ্‌মদ রফিক পটভূমির সঙ্গে আন্দোলন পরবর্তী কালে কী ভাবে এ দেশের বাঙালি সমাজে অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল, তা বর্ণনা করেছেন। আন্দোলনের প্রস্তুতি এবং সেই সময়কার প্রতিদিনের নানা ঘটনা এই প্রথম গ্রন্থবদ্ধ হওয়ায় ভবিষ্যৎ গবেষণায় গ্রন্থটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আন্দোলনটির প্রথাসিদ্ধ ইতিহাস রচিত হয়েছে নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, কিন্তু বাহান্নর ফেব্রুয়ারির ঘটনাবহুল দিনগুলি এবং পরবর্তী বছরগুলিতে উদ্‌যাপিত শহিদ দিবস তথা একুশে ফেব্রুয়ারির বিচিত্র ঘটনাবলি ইতিহাসে বিরল। আহ্‌মদ রফিক সে সব ঐতিহাসিক, একান্ত অন্তর্নিহিত ঘটনার কিছু রেখাচিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন এই আন্দোলনে সংশ্লিষ্টদের উদ্দীপনা। রেখাচিত্রের মতো ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে গ্রন্থে। অদ্যাবধি একুশের চেতনা যে-কোনও সংকটকালে কেমন করে হয়ে ওঠে উদ্দীপনাময় ও পথপ্রদর্শক, সে কথা বর্ণিত হয়েছে। এতে পাঠক দেখতে পাবেন রাজধানী ঢাকার জনজীবনের সঙ্গে একুশের উজ্জীবনের চরিত্র, সমগ্র পূর্ববঙ্গে কী ভাবে একুশের চেতনা সঞ্চারিত হয়েছিল, মফস্‌সল শহরগুলোতে ভাষা-চেতনা পালটে দিয়েছিল দীর্ঘদিনের লালিত বোধ, শাসকশ্রেণির সঙ্গে একুশের সম্পর্ক কেমন ছিল— সব মিলিয়ে প্রিয়-অপ্রিয় কিছু ঘটনার উল্লেখে এই গ্রন্থটি মাত্রাসঞ্চারী হয়ে উঠেছে।

জয়নুল আবেদিন বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা অঙ্কনের মধ্য দিয়ে কলারসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। একই সঙ্গে তাঁর সৃষ্টিগুচ্ছ হয়ে ওঠে সমকালের জীবনযন্ত্রণার অসামান্য রূপায়ণ। দেশভাগের পর তিনি চলে আসেন ঢাকায় এবং আর্ট কলেজের কয়েক জন সহপাঠীকে নিয়ে পুরনো ঢাকায় গড়ে তোলেন আর্ট স্কুল। কালক্রমে এটিই আধুনিক চিত্রচর্চার প্রাণময় কেন্দ্র হয়ে ওঠে, বর্তমানে যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে একীভূত। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের অন্তিম পর্যায়ে তিনি শিল্পাচার্যের অভিধায় অধিষ্ঠিত হন।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন
জাহাঙ্গীর হোসেন। মাওলা ব্রাদার্স, ১০০০.০০

সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে জাহাঙ্গির হোসেন লিখিত একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পূর্বে উল্লিখিত প্রসঙ্গের যুক্ত হয়েছে দেশের আধুনিক চিত্র-আন্দোলনের নানা প্রসঙ্গ। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জয়নুল আবেদিনের নির্মাণ ও সৃষ্টিতে আমরা ঐতিহ্য-জিজ্ঞাসার সঙ্গে আধুনিকতার যে অনুষঙ্গ দেখতে পাই, তাতে তাঁর মৌলিকত্ব বিশেষ ভাবে প্রতিফলিত হয়। শিল্পাচার্য ১৯৫১-৫২ সালে ইউরোপ ভ্রমণ করেন। এর ফলে তাঁর শিল্পরীতি নতুন বাঁক নিয়েছিল। দেশে ফেরার পর কয়েক বছর ধরে তিনি জলরং, তেলরং বা গোয়াশে যে-সব ছবি আঁকেন, তাতে দেশি ও বিদেশি রীতির আশ্চর্য সমন্বয় দেখা যায়। বিষয়ের দিক দিয়ে এ সব ছবিতে প্রতিফলিত হয় পূর্ববাংলার গ্রামীণ মানুষ ও প্রকৃতি; কিন্তু তাদের উপস্থাপনে তিনি আর পুরোপুরি বস্তুধর্মী থাকেননি। ওই সব মানুষ তাঁর চিত্রে ধরা দিয়েছে পাশ্চাত্য ধরনে রীতিবদ্ধ হয়ে। তাঁর সৃজনে বাংলা ও বাঙালির জীবনধারা আশ্চর্য শিল্পসুষমায় প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের লোকশিল্পের প্রতি তাঁর অনুরাগ ও আগ্রহের ফলেই লোকশিল্প মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। শিল্পাচার্যের সৃজনধর্মিতার উল্লিখিত বিষয়গুলো নানা ভাবে লেখক বিশ্লেষণ করেছেন।

গ্রন্থটিকে পূর্ণাঙ্গ জীবনী বা মূল্যায়নসমৃদ্ধ গবেষণাগ্রন্থ বলা না হলেও, আগ্রহী পাঠক তাঁর জীবন ও সৃজন সম্পর্কে কিছু নতুন তথ্য অবশ্যই পাবেন। এই গ্রন্থে শিল্পাচার্যের বাল্য ও কৈশোর, জীবনসংগ্রাম, কলকাতায় অধ্যয়নকাল-সহ তৎকালীন ভারতীয় চিত্রকলার প্রবণতা আলোচিত। রয়েছে শিল্পাচার্যের সহধর্মিণী জাহানারা আবেদিনের সাক্ষাৎকার। ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরে শিল্পাচার্যের ৮০৭টি চিত্রকর্ম সংরক্ষিত রয়েছে। লেখক জাতীয় জাদুঘরে কর্মরত হওয়ায় তাঁর সৃষ্টিকে সামগ্রিক ভাবে পর্যবেক্ষণ ও অনুভবের সুযোগ পেয়েছেন। এই বইটিতে আরও আছে, জয়নুল আবেদিনকে লেখা চিঠিপত্র ও সনদের প্রতিলিপি, জাদুঘর সংগ্রহের নির্বাচিত ১০০ ছবির প্রতিলিপি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE