Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
book review

সত্যান্বেষী পরিব্রাজক

‘গৌরকিশোর ঘোষ জন্ম শতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি’ এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে রূপদর্শী গৌরকিশোর নামে যে সঙ্কলনগ্রন্থটি নির্মাণ করেছে, সেটি এক অত্যন্ত মূল্যবান উদ্যোগ।

Gour Kishore Ghosh

ঋজু: কারামুক্তির পর আনন্দবাজার পত্রিকা-র অফিসে গৌরকিশোর ঘোষ।

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২৩ ০৭:৫২
Share: Save:

ভিন্নমুখী এক দীর্ঘ যাপনকে, দীর্ঘতর এক ব্যতিক্রমী পরিক্রমাকে কি খুব সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? দু’মলাটে তাকে আনাটাও যথেষ্ট কঠিন কাজ। বিশেষ করে যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রটির নাম গৌরকিশোর ঘোষ! এমনিতেই তো মানুষটি তাঁর বর্ণিল চরিত্র নিয়ে, দশ দিগন্তে তাঁর পরিভ্রমণ নিয়ে, তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক প্রতিষ্ঠান। তাঁর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন, অথবা আসেননি, তাঁর সৃষ্টিকর্মের গভীরতা বা ব্যাপ্তিতে অভিভূত হয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, গৌরকিশোরকে কোনও নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভব।

তাই ‘গৌরকিশোর ঘোষ জন্ম শতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি’ এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে রূপদর্শী গৌরকিশোর নামে যে সঙ্কলনগ্রন্থটি নির্মাণ করেছে, সেটি এক অত্যন্ত মূল্যবান উদ্যোগ। গ্রন্থটির চমৎকার ‘কথামুখ’-এ সম্পাদক সোহিনী ঘোষ গৌরকিশোরের জীবন-বৈচিত্রের এমন কিছু নিদর্শন তুলে ধরেছেন, যা মূল গ্রন্থে যাওয়ার আগে ওই মানুষটি ও তাঁর কাজকে চিনতে শেখায়। সোহিনী লিখছেন, “ইলেকট্রিক মিস্ত্রির ফিটার, রোড সরকার, রেস্তোরাঁর বয়, ভ্রাম্যমাণ নাচের দলের ম্যানেজার, রেসকিউ পার্টির ঠিকা শ্রমিক, আবার তার সঙ্গে সঙ্গেই গৃহশিক্ষক, প্রুফ রিডার— কিন্তু আশ্চর্য, কোনো কাজই বেশিদিন টিকতো না তাঁর। অজস্র ধরনের কাজ তাঁকে এনে ফেলেছিল অসংখ্য মানুষের সান্নিধ্যে। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল মানুষের প্রতি তাঁর টান। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সে টান তাঁর কমেনি।”

এটিই হয়তো আসল কথা, মানুষের প্রতি এই টান। এই টান বা ভালবাসার ছাপ পড়েছিল তাঁর সাংবাদিকতায়, পাশাপাশি, সাহিত্য সৃষ্টিতেও। গৌরকিশোর তৈরি করেছিলেন সামাজিক দায়বদ্ধতা, সত্যান্বেষণ ও দায়িত্ববোধের এক ভিন্নতর সংজ্ঞা। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গেরই উল্লেখ করেছেন গবেষক-সাংবাদিক সেমন্তী ঘোষ। তাঁর ভাষায়, “...স্থিরবিজুরির মতো সাহসিকতার সেই অহঙ্কার, স্ব-চেতনা কিংবা স্বাধীনতার সেই অতল প্রসন্ন স্পর্ধা আমাদের কাছে এত দিনে বড়ই অপরিচিত হয়ে গিয়েছে। তাঁর স্বাধীনতা-হীনতায় মাথা কামানোর সিদ্ধান্ত কিংবা কুকুরের বকলস পরার অভিপ্রায়, সব কিছুর মধ্যেই সেই অহঙ্কার আর স্পর্ধার উদ্ভাস, কিন্তু কখনও বাঙালির স্বভাবসিদ্ধ উচ্চনাদ ভঙ্গিতে কোনও আত্মঘোষণা ছিল না তাতে। বরং ছিল সেই বিরল গোত্রের অহঙ্কার, যার মধ্যে ‘অহং’ আসলে ‘আমি’ নয়, ‘আমরা’ আর বহুবচনের সেই অসামান্য গৌরবকে প্রতি মুহূর্ত ঘিরে থাকত এক দীপ্যমান বিবেক।”

প্রায় তিনশো পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে প্রবন্ধের সংখ্যা ৪৭। গ্রন্থটিকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে ‘রূপদর্শী: তাঁকে জানা’। দ্বিতীয় ভাগে ‘গৌরকিশোর: তাঁকে চেনা’। প্রথম ভাগে ‘রূপদর্শী’ ছদ্মনামে তাঁর লেখালিখি, সম্পাদক হিসাবে তাঁর ভূমিকা, সাংবাদিকতার মূল্যায়নের সঙ্গেই দ্বিতীয় ভাগের ব্যক্তি গৌরকিশোর সম্পর্কে নানা জনের স্মৃতিচারণ— কখন যেন মিলেমিশে গিয়েছে। যেটা হওয়া খুব স্বাভাবিকও বটে। গৌরকিশোর নিজেই তাঁর জীবনচর্চায় এই ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন কি?

গৌরকিশোরের সাহিত্যজীবন ও সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করেছেন অনিতা অগ্নিহোত্রী, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, অমর মিত্র, প্রচেত গুপ্ত, সুরঞ্জন দাস, সুমিতা চক্রবর্তী, রুশতী সেন, অভীক মজুমদার, পবিত্র সরকার প্রমুখ। গৌরকিশোরের সৃষ্ট ব্রজদার ‘গুল্প’ আসলে ‘গুল’ আর ‘গল্প’ মিলিয়ে ‘গুল্প’। পরে তা থেকে নির্মিত হয় বিখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্র ‘ব্রজবুলি’। পবিত্রবাবু লিখছেন, “আমাদের কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদের ব্রজদাকে না নাছোড়ভাবে পছন্দ হয়ে যায়। কারণ ব্রজদা উপনিষদের সময়ে মাটি খুঁড়ে প্রাচীন ভারতে বেতার পেয়েছেন, রকেটের ভগ্নাবশেষ পেয়েছেন...। প্রাচীন ভারতের বিপুল গৌরব এমন করে কে আর বলতে আর প্রমাণ (!) করতে পেরেছে?”

গৌরকিশোরের ব্যঙ্গাত্মক লেখা যে ছিল বড়ই হুল-ফোটানো! কিন্তু, গৌরকিশোরের সাংবাদিক সত্তা কি তাঁর সাহিত্যিক সত্তাকে কিছুটা হলেও ঢেকে ফেলেছিল? এই আক্ষেপ বা বিতর্ক আছে, থাকবেও। এই গ্রন্থেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যেমন অমর মিত্র মনে করেন, “সাংবাদিক গৌরকিশোরের আড়ালে রয়ে গেছেন লেখক গৌরকিশোর।” শামসুর রাহমানের যে লেখাটি এখানে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে, সেখানেও নিবন্ধকার বলেছেন, “শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকতা কি গ্রাস করবে এই শক্তিশালী লেখককে?” এ কথা অবশ্য গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সম্পর্কেও অনেকে বলেন। গার্সিয়া মার্কেস যদিও মনে করতেন, সাংবাদিকতা তাঁকে সাহিত্যিক হতে সাহায্য করেছে।

এরই পাশাপাশি এক আধুনিক নির্মম সত্যের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন জয়ন্ত সেনগুপ্ত। তাঁর উপলব্ধি, রূপদর্শীর লিখন-ভঙ্গিমার মধ্যে স্যাটায়ার-এর যে রস পরিবেশিত হয়েছে, তার যথার্থ মর্মোদ্ধার বুদ্ধিমান ও রসগ্রাহী পাঠকের পক্ষেই সম্ভব। ‘হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়’-এর চৌহদ্দিতে লালিত পাঠককুলের কাছে এই শৈলীর আবেদন কতখানি থাকবে তা বলা শক্ত। অসাধারণ বিশ্লেষণে গৌরকিশোরের উপরে আলো ফেলেছেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, “যশুরে (গৌরকিশোরের জন্মস্থান) বৈষ্ণবের সহজ জীবন-আনন্দ ও বিশ্বব্যাপী ঠান্ডা যুদ্ধে মুক্তিমার্গীর স্বাধীনতাস্পৃহা এইভাবে দুই সূত্রে এসে গৌরকিশোরকে গড়ে নিয়েছিল।”

সঙ্কলনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে হীরকদ্যুতির মতো উজ্জ্বল অজস্র মুহূর্ত। এক বিরল ব্যক্তিত্বের উপর নানা দিক থেকে আলো ফেলার এই প্রয়াসে আলোকিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এক কালখণ্ডও। এ এক বিরাট প্রাপ্তি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

book review Gour Kishore Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE