Advertisement
E-Paper

করুণাময় হৃদয় ও প্রখর কাণ্ডজ্ঞান

সাক্ষরতা প্রকাশনের বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহও কিনতে পাওয়া যায় না, মাঝে মাঝে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে পুরনো বইয়ের দোকানে উঁকি দেয় মাত্র। তাই বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষে তাঁর সমগ্র লেখাপত্র খণ্ডে খণ্ডে সুসম্পাদিত হয়ে শোভন আকারে আমাদের হাতে আসুক এ বাসনা স্বাভাবিক। 

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৪:০৭
একাগ্র: বিদ্যাসাগর কলেজে রক্ষিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯১) তৈলচিত্র। শিল্পী বি হাডসন।

একাগ্র: বিদ্যাসাগর কলেজে রক্ষিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯১) তৈলচিত্র। শিল্পী বি হাডসন।

বিদ্যাসাগর রচনাসমগ্র

১ম খণ্ড (১-২ ভাগ), ২য় খণ্ড

সম্পাদক: রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

১৪৮৫.০০ একত্রে
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়

(পরি: শিশু সাহিত্য সংসদ)

বিদ্যাসাগরের বই আমরা পড়ি কিন্তু যত্ন করে প্রকাশ করি না। প্রকাশক ও পাঠক বিদ্যাসাগর তাঁর বই সম্বন্ধে অবশ্য খুবই যত্নশীল ছিলেন। বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত গ্রন্থ-সংগ্রহটি ছিল দেখার মতো। প্রতিটি বই সেখানে একই রকমে বাঁধানো। অনেক সময় বইয়ের দামের চেয়ে বই সংরক্ষণের খরচ বেশি। অথচ বাঙালি তাদের বর্ণপরিচয়দাতার রচিত বইপত্রের সৌষ্ঠব ও নান্দনিকতা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। জ্যালজেলে পাতায় হাজার বার ছাপা ‘বর্ণপরিচয়’ আর নানা বিচিত্র-দর্শন বিদ্যাসাগর রচনাবলি ও রচনাসংগ্রহ বই-বাজারে চোখে পড়ে, দেখে বড় একটা ভরসা হয় না। বিদ্যাসাগরের লেখাপত্রের একেবারে যে কোনও সু-সংস্করণ আগে ছিল না তা অবশ্য নয়। সে-সব এখন ছাপা নেই। পুরনো সাহিত্য পরিষৎ সংস্করণ চাইলেই কি এখন পড়া যাবে! সাক্ষরতা প্রকাশনের বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহও কিনতে পাওয়া যায় না, মাঝে মাঝে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে পুরনো বইয়ের দোকানে উঁকি দেয় মাত্র। তাই বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষে তাঁর সমগ্র লেখাপত্র খণ্ডে খণ্ডে সুসম্পাদিত হয়ে শোভন আকারে আমাদের হাতে আসুক এ বাসনা স্বাভাবিক।

বাংলা লেখার পাশাপাশি বিদ্যাসাগরের ইংরেজি রচনাও তো আছে— গুরুত্বপূর্ণ চিঠি, এডুকেশন রিপোর্ট তো ইংরেজিতেই লেখা। সেগুলির গুরুত্বও অপরিসীম। ইন্দ্রমিত্রের ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ এবং বিনয় ঘোষের ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’-এর মতো গ্রন্থের পরিশিষ্টে সেই সব ইংরেজি লেখার কয়েকটির দেখা মিলবে। বাংলা লেখা যেমন বিদ্যাসাগরের নামে আছে, তেমন বেনামেও আছে। দুইয়ের চাল-চলন দু’রকম। বিপিনবিহারী গুপ্তকে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের মুখের ভাষা সহজ, নির্দ্বিধায় তিনি চলিত শব্দ ব্যবহার করেন। বেনামী রচনায় বিদ্যাসাগরের সেই মুখ প্রকাশ পেয়েছে। ‘‘আমার ইচ্ছা ও অনুরোধ এই, খুড় আর যেন, সংস্কৃত লিখিয়া, বিদ্যা খরচ না করেন। খুড়র লজ্জা সরম কম বটে। কিন্তু, লোকের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়। দোহাই খুড়!’’ এও ‘বিদ্যাসাগরী’ বাংলা। এই সব ঠিকমতো প্রকাশের জন্য কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মনোযোগী সম্পাদকের প্রয়োজন।

আপাতত তাঁর দ্বিশতবর্ষে হাতে এসেছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে প্রকাশিত দু’খণ্ড রচনাসমগ্র। প্রথম খণ্ডের আবার দুটি অর্ধ। ‘প্রথম খণ্ড-এর দুটি ভাগেরই উপজীব্য ছিল শিক্ষা’, সেখানে আছে প্রধানত পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা বিদ্যাসাগরের রচনা। আর দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে সমাজ সংক্রান্ত ছোট-বড় দশটি রচনা। দুই খণ্ডের গোড়াতেই সংহত দুটি ভূমিকায় বিদ্যাসাগরের জীবন ও কর্মের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। প্রকাশিত রচনাগুলি সম্বন্ধে বইয়ের শেষে রয়েছে প্রাসঙ্গিক তথ্যের সমাবেশ। সব মিলিয়ে বিদ্যাসাগর যত্ন করে পড়তে গেলে এই বই তিনখানি বাঙালির কাজে লাগবে বলেই মনে হয়। আশা করা যায় যে রচনাগুলি এখানে সঙ্কলিত হয়নি সেগুলি তাঁরা ভবিষ্যতে ‘বিবিধ’ শিরোনামে একটি খণ্ডে সঙ্কলিত করবেন। না করলে কিন্তু বিদ্যাসাগর রচনাসমগ্র অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

হাতে যে খণ্ডদুটি এসেছে তাতে সম্পাদনার ত্রুটি যে একেবারে নেই তা নয়। আপাত যত্নের পটচিত্র ওল্টালেই সেই অসঙ্গতি চোখে পড়ে। যেমন ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ রচনাটি দ্বিতীয় খণ্ডের সমাজ-বিষয়ক লেখাগুলির অন্তর্গত। ‘গ্রন্থপরিচয়’ অংশে জানানো হয়েছে, ‘‘বর্তমান পাঠ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ সংস্করণ থেকে গৃহীত যেখানে মূল প্রবন্ধের প্রারম্ভে একটি সংক্ষিপ্ত মুখবন্ধ স্বরূপ অংশ উল্লিখিত, যা পরবর্তী বিদ্যাসাগর রচনা সংকলনগুলিতেও অনুসরণ করা হয়েছে।’’ বেশ কথা, তবে সেই ‘মুখবন্ধ’ একই বইতে দু’বার ছাপা হলে অস্বস্তি হয়। মুখবন্ধটি ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামে লেখাটির গোড়ায় যথারীতি মুদ্রিত হয়েছে, ‘গ্রন্থপরিচয়’ অংশে ৫৫০ পৃষ্ঠায় তা আবার ছাপা হয়েছে। একই কাণ্ড ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ রচনাটির ক্ষেত্রেও চোখে পড়ে। দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন, তৃতীয় বারের বিজ্ঞাপন, চতুর্থ বারের বিজ্ঞাপন বইয়ের গোড়াতেও পাওয়া যাবে, আবার পাওয়া যাবে ‘গ্রন্থপরিচয়’ অংশে। এতে ‘গ্রন্থপরিচয়’-এর আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে, গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়নি। একই লেখা দু’বার দু’বার করে পড়তে পাঠক বিরক্তই হবেন। এ বড় সু-সম্পাদনার পরিচয় বহন করে না। আর একটা কথা বলা দরকার। বিদ্যাসাগরের সমাজ বিষয়ক লেখাগুলি খুব সহজ-পাঠ্য রচনা নয়, নানা শাস্ত্রবাক্য বিদ্যাসাগরকে উদ্ধার করতে হয়েছে। যুক্তিক্রমটিও ক্ষেত্রবিশেষে জটিল। আবার বিদ্যাসাগর পক্ষ-বিপক্ষ ব্যক্তিদের নামোল্লেখ করেন। বিদ্যাসাগরের সেই তর্কপদ্ধতি অনুসরণ করার জন্য প্রয়োজন মতো শব্দটীকা দেওয়া জরুরি, কোথাও কোথাও ব্যক্তিবিশেষের পরিচয় প্রদানও প্রয়োজন ছিল। সম্পাদনার এই কাজটি কঠিন। বিদ্যাসাগরের রচনার এই খণ্ডদুটিতে তেমন কোনও সম্পাদকীয় শ্রমচিহ্ন চোখে পড়ে না। দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় মূল্যায়ন অংশে নাম না করে বিদ্যাসাগরের ‘বিরাট ও বহুমুখী কর্মকাণ্ড ও রচনাসমূহকে নিজ নিজ তত্ত্ব-বিশ্বাসের খাঁচায়’ প্রায় জোর করে আঁটিয়ে নেওয়ার জন্য খানিক খোঁচা দেওয়া হয়েছে। বলে রাখা ভাল, উনিশ শতকের চিন্তকদের কাজের গুরুত্ব স্বীকার্য তবে তাঁদের কাজের সীমাবদ্ধতার কথা তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে উত্থাপন করা যাবে না এ কেমন কথা! শ্রদ্ধা ও পরিপ্রশ্ন দুই গুরুত্বপূর্ণ। পরিপ্রশ্ন মানে কিন্তু বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নয়।

ইন্দ্রমিত্র তাঁর ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ বইয়ের গোড়ায় নানা স্মৃতিকথামূলক রচনা থেকে মানুষ বিদ্যাসাগরকে চেনাতে চেয়েছিলেন। কথায়-উপকথায় ঘেরা সেই মানুষ বিদ্যাসাগর বিষয়ে আপাত কৌতুককর একটি কাহিনি এই খণ্ডগুলি ওল্টাতে গিয়ে মনে পড়ল। এই কাহিনি রামকৃষ্ণকথামৃতকার শ্রীম লিখেছিলেন। জীবনের প্রান্তবেলায় বিদ্যাসাগর অশ্রুসজল। তাঁর নাকি পড়াশোনা ঠিকমতো হল না, সাংসারিক নানা কাজ। নিবিড় পড়াশোনার সময় কোথায়! সত্য হোক, অলীক হোক, কাহিনিটি জরুরি। এই দুই খণ্ডে বিদ্যাসাগরের যে লেখাগুলি সঙ্কলিত হয়েছে তাতে কাজের বিদ্যাসাগরকে চেনা যায়। ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কী ভাবে অগ্রসর হওয়া যায় তা বিদ্যাসাগরের অন্যতম অনুসন্ধানের বিষয়। তাঁর সংসারটি বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সমাজে সুবিস্তৃত। বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সমাজকে তিনি গড়েপিটে নিতে চাইছেন। সেই কাজে নিজের বৃহত্তর পড়াশোনার সময় কমে যায় বটে।

বাংলা শিক্ষার উপযোগী বই লেখেন তিনি, বইগুলি কঠিন নয়। সংস্কৃত কলেজের ছাত্র বিদ্যাসাগর জানেন ব্যাকরণের বিভীষিকা কাকে বলে! তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’-এ যে শব্দগুলিকে এখন কঠিন বলে মনে হয় তা কিন্তু সে কালে বেশ ব্যবহৃত হত। ‘কুজ্ঝটিকা’ শব্দটি কেবল বর্ণপরিচয়েই ছিল না, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসেও ছিল। বিদ্যাসাগর হিন্দি, সংস্কৃত, ইংরেজি থেকে অপরের লেখা যখন বাংলায় অনুবাদ করছেন তখন মূলের দিকে তাঁর যত না নজর তার থেকে ঢের বেশি নজর অনূদিত পাঠ্যের প্রতি। শেক্সপিয়রের নাটককে দেশজ ‘ভ্রান্তিবিলাস’ করে তুলেছেন। তাঁর ‘সীতার বনবাস’ রামায়ণ ও রামায়ণকেন্দ্রিক পরবর্তী রচনার উপাদানে অশ্রুসজল বাঙালি রামের কথা হয়ে উঠেছে। ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’-র অনুবাদে ‘অহেতুক’ কাহিনিভাগ বাদ দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিছক প্রাইমার-প্রণেতা বলে চিহ্নিত করেছিলেন, বিদ্যাসাগরের কৃতিত্বকে হয়তো একটু খাটোই করতে চান বঙ্কিম। সত্যি কথা হল প্রাইমার লেখা ছোট কাজ নয়। সে কাজ করেছিলেন বলে হয়তো বঙ্কিমের মতো সৃজনশীল সাহিত্য রচনা করার সময় পাননি বিদ্যাসাগর। তবে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের দোলা রবীন্দ্রনাথের কানে লেগেই ছিল, বিভূতিভূষণের বালক অপু পাঠশালায় ‘সীতার বনবাস’-এর ধ্বনিঝঙ্কারে মুগ্ধ। ‘সংস্কৃতভাষা ও সংস্কৃতসাহিত্যশাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব’-এ কথা ও আখ্যায়িকার সূক্ষ্ম পার্থক্যকে গুরুত্ব দেননি বিদ্যাসাগর। কাজ করতে গেলে অনেক কিছু চালিয়ে নিতে হয়— শেষ বয়সে এসে মনে হয় নির্ভেজাল পড়ার অবসর মিলল না। সমাজ বিষয়ক লেখাপত্রেও যুক্তি-কাঠামো গড়ে তোলাই উদ্দেশ্য, সেই যুক্তি সাধারণের মনে যেন দাগ কাটে। শাস্ত্র-বিচারের নিরন্তর গভীর অভ্যাসের চাইতে বিধবা বিবাহ চালু করার জন্য যেটুকু শাস্ত্রবচন কাজে লাগে তা খুঁজে বার করা চাই। শাস্ত্রের পরেও আরও কিছু আছে, সে মানুষের হৃদয়। তাতে দয়ার সঞ্চার ঘটানো চাই। বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত প্রস্তাবের শেষে করুণাসাগর লেখেন, ‘‘তোমরা মনে কর, পতি বিয়োগ হইলেই স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না ... কিন্তু তোমাদের এই সিদ্ধান্ত যে নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক, পদে পদে তাহার উদাহরণ প্রাপ্ত হইতেছে।’
করুণাময় হৃদয় আর প্রখর কাণ্ডজ্ঞানই বিদ্যাসাগরের সামর্থ্য, সেই সামর্থ্যই লেখায় প্রকাশিত। সেই প্রকাশ কোথাও কোথাও সহজতায় স্মৃতিধার্য, সাহিত্যগুণান্বিত। এ কম বড় কথা নয়। সজলনয়ন বিদ্যাসাগর তাঁর এই সব কাজের উপযোগিতা জানেন, তবু উপযোগিতার বাইরে নিজের মতো পড়ার সময় খুঁজে ফেরেন।

আমরা আপাতত তাঁর লেখা পড়ি। তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষে এই হোক আমাদের কাজ।

Iswar Candra Vidyasagar Books by Vidayasagar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy