Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

গড়ে নিয়েছেন নিজস্ব চিত্রভাষা

ফোটা পলাশ আর ঝরা মহুয়ার কালটুকুকেই বেছে নিয়েছিলেন তরুণ মজুমদার তাঁর ‘গণদেবতা’ ছবিতে, দুর্গা ও যতীনের দেখা হওয়ার মুহূর্তে।

আত্মানুসন্ধান: তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘অমর গীতি’ চলচ্চিত্রে নিধুবাবুর ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

আত্মানুসন্ধান: তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘অমর গীতি’ চলচ্চিত্রে নিধুবাবুর ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

শিলাদিত্য সেন
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

লালমাটি অঞ্চলে গ্রীষ্মে দিন পাঁচ-ছয় অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটে। নিষ্পত্র পলাশ গাছে ফুল ফুটে থাকে, গোটা গাছ জুড়ে। আবার মহুয়া গাছের সমস্ত ফল ঝরে যায়, জড়ো হয়ে পড়ে থাকে গাছটার নীচে। সেই ফোটা পলাশ আর ঝরা মহুয়ার কালটুকুকেই বেছে নিয়েছিলেন তরুণ মজুমদার তাঁর ‘গণদেবতা’ ছবিতে, দুর্গা ও যতীনের দেখা হওয়ার মুহূর্তে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে এ-ছবির পটভূমি ছিল গত শতাব্দীর ইংরেজ-শাসনাধীন অবিভক্ত বাংলাদেশ। সেখানে দুর্গা দেহোপজীবিনী, আর যতীন ব্রিটিশ সরকারের নজরবন্দি। মহুয়া কুড়োতে কুড়োতে পলাশ গাছের তলায় নির্জনে যতীনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় দুর্গার... আশ্চর্য এক মুহূর্ত... যার উপর ভর করে যতীন-দুর্গার অনুচ্চারিত সম্পর্ক, তরুণবাবুর ভাষায় প্রায় ‘অস্ফুট আলোর মতো’ জেগে থাকে গোটা ছবি জুড়ে।

তারাশঙ্করের উপন্যাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন এ-কাহিনি কতখানি ব্রিটিশ-উপনিবেশ বিরোধী, কতখানি সামন্তপ্রথা বিরোধী। সেই কাহিনিকেই নিজের ছবিতে দস্তুরমতো সিনেমার ভাষায় যখন তৈরি করেন তরুণবাবু, নতুন মাত্রা আসে তাতে। বরাবরই বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের কাহিনি অবলম্বনে নিজের ছবিতে নতুন কোনও চলচ্চিত্রীয় আখ্যান নির্মাণ তাঁর স্বভাব-বৈশিষ্ট্য। ‘‘ঔপন্যাসিকের মূল ভাবটাকে ফোটানোর জন্যে চিত্রনাট্যকার-পরিচালক একের পর এক রূপকল্প খুঁজে বার করে’’ চলেন, ‘দর্শকদের উপহার দেবেন’ বলে... এ-বইয়ে ‘সাহিত্য আর চলচ্চিত্র’ শীর্ষক যে রচনাটিতে এমন মন্তব্য করেন তিনি, তাতে কথায়-কথায় ‘গণদেবতা’র অনুষঙ্গ এসে পড়লেও যোগ করতে ভোলেন না: ‘‘নিজের ছবির উদাহরণ দেওয়াটা মোটেই রুচির পরিচয় নয়— আমি জানি।’’

আসলে নিজের চলচ্চিত্র-জীবনের দীর্ঘ যাত্রায় সাহিত্যের ন্যারেটিভ প্যাটার্ন-কে ভাঙচুর করে সিনেমার নিজস্ব নান্দনিক প্যাটার্ন-এ তা সাজিয়ে নেন বলেই তাঁর এ বইটির বিভিন্ন প্রবন্ধে ক্রমাগত প্রশ্ন তুলতে থাকেন তরুণ মজুমদার, কোনও সাহিত্যকে চলচ্চিত্রায়িত করার অর্থ কি এই যে সে ছবিকে আমরা শুধু কাহিনির দৃশ্যশ্রাব্য রূপেই দেখতে বা দেখাতে চাইব, এর বাইরে কি কোনও আদল থাকতে নেই সিনেমার, কোনও ছবি কি কেবল সাহিত্যের ফিল্ম-ভার্সান মাত্র? ‘‘এ যেন লেখারই আরেকটা অনুবাদ— সেলুলয়েডের ফিতেয়!’’— লিখেছেন তরুণবাবু।

নকশিকাঁথা
তরুণ মজুমদার
২০০.০০, দে’জ পাবলিশিং

এ থেকে এমন একটা ধারণারও জন্ম হয় যে, সাহিত্যের বহুমাত্রিক জটিলতা বা সূক্ষ্মতা চলচ্চিত্রের অনায়ত্ত। চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা বা ক্ষমতাই খাটো হয়ে আসে এতে। ঠিক এর উল্টো ধারণাই পোষণ করতেন রবীন্দ্রনাথ। ২৬ নভেম্বর ১৯২৯-এ লেখা চিঠিতে তিনি সিনেমার আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা রীতিমতো নির্দিষ্ট করে দিচ্ছেন: ‘‘এই চলমান রূপের সৌন্দর্য বা মহিমা এমন করে পরিস্ফুট করা উচিত যা কোনো বাক্যের সাহায্য ব্যতীত আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক করতে পারে। তার নিজের ভাষার মাথার উপরে আর একটি ভাষা কেবলি চোখে আঙুল দিয়ে মানে বুঝিয়ে যদি দেয় তবে সেটাতে তার পঙ্গুতা প্রকাশ পায়।’’ রবীন্দ্রনাথের এই শিল্পমনের প্রতি মান্যতা জানিয়ে তরুণবাবু পেশ করেছেন নিজের শিল্পমত, ‘‘একজন ভালো চলচ্চিত্রকার যখন কোনও সাহিত্যকর্মের দিকে আকৃষ্ট হন... তাঁর প্রথম কাজই হবে সাহিত্যের ফর্মটিকে ভেঙে ফেলা। তারপর সেই ভগ্নস্তূপ থেকে তিনি শুরু করবেন তাঁর নতুন নির্মাণ।... যে কনটেন্ট-এর দিকে আকৃষ্ট হয়ে তিনি এই ছবিটি তৈরি করার দিকে ঝুঁকেছিলেন, সেটাকে ফোটাবার জন্য তিনি তখন লেগে পড়বেন নতুন এক ভাষাসৃষ্টির কাজে। এ ভাষা সাহিত্যের ভাষা নয়— একেবারেই ছবির ভাষা।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা যে কতদূর বিস্তৃত হতে পারে, তেমনই অনুপম শিল্পমাধ্যম হয়ে ওঠার দাবি নিয়ে ১৯৫৫-য় হাজির হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’। তরুণবাবুর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে উঠে আসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুবোধ ঘোষের সাহিত্যভাষা কী ভাবে সিনেমার ভাষা হয়ে উঠেছিল সত্যজিৎ বা ঋত্বিকের হাতে, তাঁদের ‘অশনি সংকেত’ কিংবা ‘অযান্ত্রিক’-এ।

এমনকি দু’টি ভাষার বর্ণমালার তফাতও স্পষ্ট করে দেন তিনি: ‘‘কেউ যদি কাগজের ওপর কালি-কলম ব্যবহার না করে সেলুলয়েডের ফিতের ওপর আলো দিয়ে লেখেন,— ‘ক’ ‘খ’ ‘গ’ এসব অক্ষর ব্যবহার না করে গাছ-পাতা-লতা-ফুল-জল-নদী-নৌকো-মানুষের মুখ ইত্যাদিকে বর্ণমালা হিসেবে ব্যবহার করে মনের ভাব ফোটাতে প্রয়াসী হন— যার ভিতর দিয়ে যিনি বলছেন আর যিনি দেখছেন— দুপক্ষই ভাবের দিক থেকে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে গেলেন... ’’।

তরুণবাবুর মনে আছে, একবার সত্যজিৎ রায় তাঁকে বলেছিলেন ‘গুছিয়ে গপ্পো বলাটা একটা মস্ত আর্ট’। সেই আর্টের চিহ্নই বার বার ফুটে উঠতে দেখেছি আমরা তরুণবাবুর ছবিতে। অভিনব অথচ গ্রহণীয় চিত্রভাষায় গল্প-বলা বাংলা ছবিকে ক্রমাগত প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনস্ক করে তুলেছেন তিনি, তাতে বুনে দিয়েছেন অজানা অচেনা মানুষের জীবন এবং তাদের নিভৃত সম্পর্ক।

কেমন সেই সব মানুষ, কেমনই বা তাদের জীবন? ‘খুঁতওয়ালা মানুষ’, বলেন তরুণবাবু। অসম্পূর্ণ, নানা দোষেগুণে-ভরা ত্রুটিযুক্ত মানুষ, ‘ইমপারফেক্ট পার্সন’। তাঁর বগুড়ার শৈশবস্মৃতি থেকে, সারা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন, সমাজের মান্যতা ছাড়াই কত মানুষ প্রতি দিন কত গুণ ও ভাল কাজের পরিচয় দিয়ে চলেন। বাইরের সাফল্য নেই বলেই বরং তাঁরা অন্তরের ঐশ্বর্যে এত সমৃদ্ধ। ‘‘আমি আইডেনটিফায়েড হতে পারি এঁদের সঙ্গে, তাই এঁরা আমার ছবিতে এত প্রধান হয়ে ওঠেন,’’ মনে করেন তরুণবাবু।

১৯৫৯-এ যাত্রিক-এর ব্যানারে তরুণবাবুর প্রথম ছবি ‘চাওয়া পাওয়া’ থেকেই ‘খুঁতওয়ালা মানুষ’ খুঁজে গিয়েছেন তিনি। ‘কাঁচের স্বর্গ’ কিংবা ‘পলাতক’ পেরিয়ে যখন স্বনামে ছবি-করা শুরু, তখনও ‘আলোর পিপাসা’, ‘বালিকা বধূ’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘ঠগিনী’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘অমর গীতি’, কিংবা নতুন শতকে এসে ‘আলো’ বা একেবারে হালফিল ‘ভালবাসার বাড়ি’, সব ছবিতেই সেই ‘ইমপারফেক্ট পার্সন’।

এই সূত্রেই এসে পড়ে তাঁর সেই অসামান্য ছবিটি, এক তস্কর আর এক দেহোপজীবিনীকে নিয়ে— ‘সংসার সীমান্তে’। মনখারাপ হয়ে যায় যখন শুনি যে এই ছবিটি আর কোনও দিন দেখতে পাওয়া যাবে না, কারণ ছবিটির কোনও প্রিন্টই আজ আর টিকে নেই। হয়তো এ জন্যেই আত্মবিস্মৃত বাঙালি আজও তার বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকারদের নিয়ে কোনও ইতিহাস তৈরি করে উঠতে পারেনি!

‘ভালো ছবি’, আর সঙ্গে সঙ্গে ‘জনপ্রিয় ছবি’।... এই দুটো ব্যাপারই এক সঙ্গে মিলে যাওয়া চাই। নইলে ছবি বানানোর একটা বড় উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়।— নিজের শিল্প-অভিপ্রায় স্পষ্ট করেছেন তরুণবাবু, এ-বইয়ের ‘কেমন ছবি করতে চাই’ লেখাটিতে। উদাহরণে এনেছেন সেই অমোঘ চ্যাপলিনকে, যিনি ‘‘বক্তব্য কিংবা স্টাইলের স্বকীয়তা বজায় রেখেও এমন ছবি পর পর করে গেছেন যেখানে জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার নীতিটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE