Advertisement
E-Paper

নানা রঙের ক্যানভাসে আলোছায়ার কাহিনি

বাংলা সাহিত্যের অবহেলিত দিক হল বংশ-ইতিহাসচর্চা। প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব ইতিহাস থাকে এবং তা নিয়ে বিশদ আলোচনাও হয়। কিন্তু বংশ-ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ বিশেষ চোখে পড়ে না। এই উদাসীনতার কারণ উন্মোচন করা না গেলেও, বংশের ইতিহাস সংরক্ষণে জাতির ইতিহাসও যে সমৃদ্ধ হয়, তা বলাই বাহুল্য। শান্তনু ঘোষের সংকলন ও সম্পাদনায় মুন্সীয়ানায় চল্লিশ পুরুষ (কমলিনী, পরি: দে’জ, ২০০.০০) বইটি এই চর্চাকেই পুষ্ট করেছে।

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০

বাংলা সাহিত্যের অবহেলিত দিক হল বংশ-ইতিহাসচর্চা। প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব ইতিহাস থাকে এবং তা নিয়ে বিশদ আলোচনাও হয়। কিন্তু বংশ-ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ বিশেষ চোখে পড়ে না। এই উদাসীনতার কারণ উন্মোচন করা না গেলেও, বংশের ইতিহাস সংরক্ষণে জাতির ইতিহাসও যে সমৃদ্ধ হয়, তা বলাই বাহুল্য। শান্তনু ঘোষের সংকলন ও সম্পাদনায় মুন্সীয়ানায় চল্লিশ পুরুষ (কমলিনী, পরি: দে’জ, ২০০.০০) বইটি এই চর্চাকেই পুষ্ট করেছে। মাদার অব পার্ল শিল্পী অনুকূলচরণ মুন্সি, অন্নদা মুন্সি-র মতো বহু গুণী ব্যক্তি এই বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সম্পাদক সামাজিক কর্তব্য পালনের পাশাপাশি পরিশ্রমী আলোচনায় এক বিস্মৃত পরিবারের ইতিহাসকে আলোকিত করেছেন।

ব্যক্তিজীবনে তিনি সব সময় নিজের সত্তাকে খুঁজেছেন নানা ভূমিকায় রোপিত গণ্ডির ফাঁকফোকর দিয়ে। শিল্পী সোমনাথ হোরের স্ত্রী, বিচারপতি কুলদাচরণ দাশগুপ্তর মেয়ে, রাজনীতির উত্তাল সময়ের সাক্ষী, অসুস্থ মায়ের সেবিকা, মেয়ের মা— এত বিচিত্র ভূমিকা পালনের ফাঁকে তিনি তাঁর শিল্পসত্তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। শিল্পী-লেখক রেবা হোর তাঁর আত্মজৈবনিক আমার কথা—কিছু কিছু (কারিগর, ১৫০.০০) বইটিতে সেই সব সময়েরই পুরনো আলোছায়ার কাহিনি নানান রঙের ক্যানভাসে সাবলীল গদ্যে তুলে ধরেছেন। প্রচ্ছদ অলঙ্করণও তাঁর। উৎসাহী পাঠকের মন ভরাবে এ গ্রন্থ, সন্দেহ নেই।

নতুন আঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরাদেবীর সঙ্গে কবির সম্পর্কের বহু স্তর উন্মোচন করেছেন সাদ কামালী তাঁর আলাপচারি ইন্দিরাদেবী (অভিযান, ১৬০.০০) বইতে। প্রিয়জন রবিকাকার অব্যক্ত মনের ভাব, ভাবনা, আবেগ, বিস্ময়ের অসংকোচ প্রকাশ যেমন ইন্দিরাদেবীকে লেখা পত্রাবলির ছত্রে ছত্রে, তেমনই সদ্য তরুণ রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলেত প্রবাসে এবং ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও। আলাপচারির ভঙ্গিতে এই বইটি রবীন্দ্র-গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করল, সুখপাঠ্য ভাষায় তথ্য বিবৃতিতে পাঠকের মনকে কৌতূহলী করে তোলার রসদও এতে মজুত।

মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য আজ বিস্মৃত শিশুসাহিত্যিক। অথচ তাঁর সৃষ্ট জাপানি গোয়েন্দা ‘হুকাকাশি’ চরিত্রটি দারুণ আকর্ষণীয় হয়েছিল। তাঁর সম্পাদিত ‘রামধনু’ ছোটদের কাছে ছিল ভীষণ প্রিয় পত্রিকা। ছোটদের মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ও তাঁর রামধনু পত্রিকা (পুস্তক বিপণি, ৩০০.০০) শীর্ষক বইয়ে পার্থ সেনগুপ্ত জীবনী, বংশলতিকা, কিছু দুর্লভ ছবি এবং তাঁর রচনার নানা দিক তুলে ধরেছেন। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের ওপর এই পূর্ণাঙ্গ আলোচনা শিশুসাহিত্যের আগ্রহী পাঠক ও গবেষকদের সংগ্রহযোগ্য।

‘সমকালের জিয়নকাঠি সাহিত্য পত্রিকা’ (সম্পা: নাজিবুল ইসলাম মণ্ডল, ৩০০.০০) প্রকাশ করল শচীন দাশ স্মরণ সংখ্যা। আছে সদ্য প্রয়াত সাহিত্যিকের অপ্রকাশিত রচনা, নিবন্ধ, প্রবন্ধ, শচীন দাশের নেওয়া সাক্ষাৎকার, তাঁর সাক্ষাৎকার, স্মৃতিকথা, আত্মকথন ও ব্যক্তিগত গদ্য, প্রতিবেদন প্রভৃতি। গ্রন্থ সমালোচনায় শচীন দাশকে খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। প্রবন্ধ-নিবন্ধে তিনি যে অনেক সমৃদ্ধ-পরিব্যাপ্ত, সে বিষয়ে জানার সুযোগ ঘটবে পাঠক-গবেষকদের। গ্রন্থপঞ্জি, জন্মপঞ্জি, ছবি-অলংকরণ প্রভৃতি নিয়ে বিস্তারিত প্রয়াস।

মীর মশাররফ হোসেন উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর রচিত বিষাদ-সিন্ধু, উদাসীন পথিকের মনের কথা, জমীদার দর্পণ প্রভৃতি একদা সাহিত্যানুরাগী সমাজকে আলোড়িত করেছিল। পূর্ববঙ্গে এই আলোড়নের ঐতিহ্য বজায় আছে অদ্যাবধি। কিন্তু নানা কারণে এ পার বাংলায় মশাররফ সম্পর্কিত আলাপ আলোচনার ধারা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে স্থান পাচ্ছেন মশাররফ।— গবেষক এ টি এম সাহাদাতুল্লার আলোচনা এবং সংস্কৃতি-তে, বিষয়: মীর মশাররফ হোসেন সংখ্যা (সম্পা: সাইফুল্লা ও সুকান্ত মুখোপাধ্যায়, ২৫০.০০)। পত্রিকাটি আপাতত একটা চলার ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করে নিয়েছে। সম্পাদক ‘আমাদের কথা’-য় বলেছেন: ‘‘আমরা চাইছি বাঙালি মুসলমানের যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে সেই ঐতিহ্যের দিকটিকে তুলে ধরতে। সেই সূত্রে মুহ্যমান মুসলমান জনসমাজকে মানসিক ভাবে উদ্বুদ্ধ করতে। এই কাজটা আজ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত সাহিত্য ও সমাজেতিহাস বিষয়ক গ্রন্থগুলিতে বাঙালি মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক ভূমিকার কথা তেমন গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখিত হয়নি। নিতান্ত অসম্পূর্ণ খাপছাড়া বর্ণনা স্থান পেয়েছে।’’ সেই কারণেই এই বিশেষ সংখ্যা দিয়ে প্রথম উদ্যোগ।

পরিমল গোস্বামীর জ্যেষ্ঠ পুত্র শতদল বড় হয়েছিলেন সাহিত্যের পরিমণ্ডলে। সরোজ আচার্য, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, দাদাঠাকুর, শশিশেখর বসু থেকে শুরু করে শিবরাম চক্রবর্তীর ছিলেন তিনি স্নেহধন্য। মেজমামা জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাগচী ছিলেন তাঁর হাস্যরসের গুরু। এক সময় তিনি প্রচুর লেখালিখি করেছেন। দু’টি পত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন। তাঁর লেখা গল্প, কবিতা এবং ছড়া নানা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তবে সে সব কখনও গ্রন্থিত হয়নি। জীবনের শেষ পর্বে ‘দেশ’ পত্রিকায় সম্পাদক সাগরময় ঘোষের অনুরোধে বিখ্যাত সাহিত্যিকদের বিষয়ে কয়েকটি রম্য প্রবন্ধ লেখেন। তাঁর মৃত্যুর পঁচিশ বছর পরে সেই রচনাগুলি সাত পুরুষের রম্য জগৎ (দীপ, ১৫০.০০) নামে গ্রন্থিত হল। বইটি বাংলা রম্যসাহিত্য-চর্চার শুকিয়ে আসা ধারায় একটি উজ্জ্বল প্রবাহ। বইয়ের প্রচ্ছদের ছবিগুলির পাঁচটি পরিমল গোস্বামীর তোলা। শিবরাম চক্রবর্তীর ছবিটি তুলেছিলেন হিমানীশ গোস্বামী। জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাগচীর স্কেচটি কালীকিঙ্কর ঘোষ দস্তিদারের আঁকা।

স্বাধীনতা সংগ্রামী অক্ষয়কুমার কয়াল (১৯১৪-২০০৪) ছিলেন পুথি সংগ্রাহক ও পুথি বিশারদ। তিনি প্রায় চার হাজারের বেশি পুথি সংগ্রহ করেছিলেন এবং পরে পুথিগুলোর বেশির ভাগটাই বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে দান করেছিলেন। সম্পাদনা করেছেন অনেকগুলি পুথি, তার মধ্যে ময়ূরভট্টের ‘ধর্মমঙ্গল’, রূপরাম চক্রবর্তীর ‘ধর্মমঙ্গল’, প্রাণরাম কবিবল্লভের ‘কালিকামঙ্গল’, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল’, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের কথা মাথায় রেখে প্রত্ন-পুথির পাঠশালা/অক্ষয়কুমার কয়াল (সৃজনী ভারত, প্রাপ্তিস্থান: দে বুক, ১৮০.০০) শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনায় উদ্যোগী হন অভিজিৎ বেরা। বইটিতে নানা দিক থেকে অক্ষয়কুমার কয়ালের জীবন ও কর্মের পর্যালোচনা, তাঁর বই ও প্রবন্ধের তালিকা, তাঁর লেখা কিছু দুর্লভ প্রবন্ধ, তাঁকে লেখা বিশিষ্টদের চিঠি ইত্যাদি সংকলন করে পাঠকবর্গের মননে পৌঁছে দেওয়ার এক আন্তরিক প্রয়াস নজরে পড়ে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy