মণিপুরের দুই শিল্পী শরত্ সিংহ ও দেবেন্দ্র সিংহ একসঙ্গে প্রদর্শনী করলেন সম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। দুজনেরই জন্ম ইম্ফলের নিনগোমথং-এ ১৯৬১ সালে। শরত্ বিশ্বভারতী থেকে শিল্পকলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা নিয়েছেন। দেবেন্দ্র-র শিল্পশিক্ষা ইম্ফল আর্ট কলেজ, কলকাতার কলেজ অব ভিজুয়াল আর্টস-এ। এর পরে তিনি বিশ্বভারতীর কলাভবনেও পোস্ট ডিপ্লোমা করেন। শান্তিনিকেতনের উত্তরাধিকার দুজনের ছবিতেই প্রচ্ছন্ন রয়েছে। সেইসঙ্গে রয়েছে মণিপুরের পাহাড় ঘেরা নৈসর্গিক আবহ। প্রকরণে ও আঙ্গিকে দুজনে স্বভাবতই স্বতন্ত্র।
শরত্ সিংহ বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁর কাঠখোদাইয়ের ছাপচিত্রে। তাঁর মোট ২০টি ছবির মধ্যে মাত্র একটি অ্যাক্রিলিকে করা। বাকি ছবি উড কাট ও উড এনগ্রেভিং মাধ্যমের। কাঠের উপরিতল থেকে কেটে রিলিফ বা নতোন্নত পদ্ধতিতে ছাপ তোলার প্রকরণ অনেক প্রাচীন। পাশ্চাত্যে পঞ্চদশ, ষোড়শ শতক থেকে উড-কাটের প্রকরণ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। উড-কাটে কাঠ কেটে নেওয়া হয় গাছের দৈর্ঘ্য বরাবর। এনগ্রেভিং-এ কাঠ নির্বাচন করা হয় গাছের গোলাকার প্রান্ত বরাবর। আমাদের দেশে আধুনিকতার সূচনাপর্ব থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে উড-কাট। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ গ্রন্থ কাঠখোদাইয়ের মাধ্যমে অলঙ্কৃত হয়েছিল। বটতলার কাঠখোদাই লৌকিক-নাগরিক চিত্রের অত্যন্ত সুপরিচিত একটি ঘরানা। এর পর কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে কাঠখোদাই নিয়ে নিমগ্ন চর্চা হয়েছে। কলকাতায় সফিউদ্দীন আমাদ ও হরেন দাস এই মাধ্যমটিকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করেন। উড-এনগ্রেভিং-ই আরও পরিশীলিত হয়ে উড-ইন্তালিও মাধ্যমে উন্নীত হয়, যে ক্ষেত্রে সনত্ করের অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
কাঠ-খোদাইয়ের বিকাশের এই প্রেক্ষাপট দেখলে শরত্ সিংহের কাজে অত্যন্ত সমৃদ্ধ আধুনিকতাবাদী মননের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি এঁকেছেন দু ধরনের ছবি। পাহাড়ি নিসর্গের বিমূর্তায়িত রূপ এবং অভিব্যক্তিবাদী বিশ্লিষ্ট অবয়বী রূপের ছবি। কাঠখোদাই ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য থাকে টেক্সচার বা বুনোটের বিন্যাসে। ছাপ নেওয়া হয় উপরিতল থেকে। কাঠ কেটে শিল্পী যে রৈখিক অলঙ্করণ তৈরি করেন, তা যত পরিশীলিত হয়, ছবিতে ততই নৈসর্গিকের উপর অনৈসর্গিকের আলো এসে পড়ে। শরতের ছবি এদিক থেকে নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ। তিনি যে নিসর্গ এঁকেছেন, তাতে নিসর্গের স্পন্দনটুকুমাত্র আছে। সেই নিসর্গকে তিনি অভিব্যক্তিবাদী বিমূর্ততায় রূপান্তরিত করেছেন। রেখার বিভিন্ন বিন্যাস, আলো ও ছায়াতপের পারস্পরিক সংলাপ তাঁর ছবিতে আখ্যান নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র এক বিশুদ্ধ চিত্রীয় পরিমণ্ডল তৈরি করে, যাতে আজকের সময়ের বহুমাত্রিকতা স্পন্দিত হয়। অবয়বী ছবিতেও তিনি অভিব্যক্তিবাদী ডিস্টর্সন বা বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। তেমনই একটি ছবিতে দেখি পুরুষ ও নারী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। রূপের ভাঙনে ও আলোছায়ার দ্বান্দ্বিকতায় এক করুণাঘন পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়েছে।
দেবেন্দ্র সিংহ ক্যানভাসের উপর তেলরঙে ১১টি ছবি এঁকেছেন। তাঁর বিষয় মূলত পাহাড়ি নিসর্গ। প্রেক্ষাপটে আলো রেখেছেন। সেই আলোর ভিতর নানা মাত্রার সামান্য ছায়াতপের সঞ্চার ঘটে। সেই আলোকিত প্রেক্ষিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে পুঞ্জিত শিলাস্তর। সেই শিলাস্তরের আভাস প্রকৃত পাহাড়ের অনুষঙ্গ ততটা বহন করে না, অর্থাত্ সেই স্বাভাবিকতাকে ততটা প্রতিফলিত করে না, যতটা সেই পাহাড়ের বিস্তীর্ণ উদাত্ততাকে আভাসিত করে। এই যে পাহাড়ি নিসর্গের স্মৃতিকে অন্য এক আয়তনময়তায় ব্যঞ্জিত করে তুলে বিশুদ্ধ বিমূর্তায়িত চিত্রপ্রকল্পের দিকে যাওয়া, এখানেই শিল্পী এক সঙ্গীতময় পরিমণ্ডল রচনা করে তুলেছেন, যাতে অভিব্যক্ত হয় বিস্ময়মিশ্রিত আনন্দের স্পন্দন। ভারতীয় চিত্রকলায় অনেক শিল্পীই হিমালয় বা অন্যান্য পাহাড় নিয়ে ছবি করেছেন। অণুচিত্রেও পাহাড় এসেছে নানা ভাবে। নিকোলাস রোয়েবিক-এর (১৮৭৪-১৯৪৭) হিমালয়-নিসর্গ আধুনিক চিত্রকলার বিশেষ সম্পদ। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন শিল্পীর ছবিতে হিমালয় প্রাকৃতিক উদাত্ততার প্রতীক হয়ে উঠেছে। দেবেন্দ্র সিংহের পাহাড়ি নিসর্গগুলি সেই ধারাতেই বিশিষ্ট সংযোজন। নিসর্গের অন্তর্নিহিত বির্মূততাকে তিনি মননদীপ্ত ভাবে চিত্রায়িত করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy