জৌলুষহীন: পুজোর জাঁকজমকে এ বার ভাটার টান। নিজস্ব চিত্র
মুখ ভার বিশ্বকর্মার। আর্থিক মন্দার প্রভাবে জায়গায় জায়গায় পুজোর বাজারে টান। মন্দার বাজারে বনগাঁর চিরুনি শিল্প ধুঁকছে। বুধবার, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আরও স্পষ্ট হল সেই ছবি।
শুরুটা হয়েছিল নোট বাতিলের সময় থেকে। সেই ধাক্কা কোনও ভাবে কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আর্থিক মন্দার ধাক্কা নানা ক্ষেত্রে। ব্যতিক্রম নয় বনগাঁর চিরুনি শিল্প। মন্দার প্রভাবে চিরুনি কারখানাগুলিতে উৎপাদন কমছে। পুজো হলেও বাজেট আগের তুলনায় অনেক কম।
বনগাঁ শহরের নিউ মার্কেট-সংলগ্ন এলাকায় যশোর রোডের পাশে এ বারও পুজোর আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু গতবারের তুলনায় বাজেট প্রায় অর্ধেক হয়েছে। বনগাঁ সেলুলয়েড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সম্পাদক রঞ্জন সেন বলেন, ‘‘আর্থিক মন্দার প্রভাব পড়ছে। মালিক শ্রমিকদের রোজগার কমেছে। শ্রমিকদের কাছ থেকে এ বছর তাই পুজোর চাঁদা বেশি নেওয়া সম্ভব হয়নি। গত বছর পুজোর বাজেট ছিল ৮০ হাজার টাকা। এ বার বাজেট কমিয়ে করা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা।’’
সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, বনগাঁয় এখন ছোট-বড় মিলিয়ে চিরুনি কারখানার সংখ্যা ১২৫টি। ৩৭২ জন কাজ করেন। গত বছরও শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৪৭২। রঞ্জন জানান, রোজগার না থাকায় গত এক বছরে প্রায় ১০০ জন শ্রমিক কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। যে শ্রমিক আগে প্রতি সপ্তাহে আয় করতেন প্রায় ২৬০০ টাকা, এখন তা কমে হয়েছে ১৬০০ টাকা। পালিশ শ্রমিকেরা আগে পেতেন সপ্তাহে ১৪০০ টাকা। এখন পাচ্ছেন ৯০০ টাকা। তা-ও সব সময়ে কাজ থাকছে না।
আর্থিক মন্দার প্রভাবের কথা জানাচ্ছেন কারখানার মালিকেরাও। বনগাঁ সেলুলয়েড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহাদেব ঘোষ বলেন, ‘‘আর্থিক মন্দার প্রভাব চিরুনি শিল্পে যথেষ্ট পড়েছে। বাজারে মন্দা। চিরুনির চাহিদা কমেছে।’’ মহাদেবের বনগাঁ স্টেশন রোড এলাকায় চিরুনির দু’টি কারখানা রয়েছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় তিনিও শ্রমিক কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
বনগাঁর তৈরি চিরুনির ভাল চাহিদা রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরল, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ-সহ দেশের বেশ কিছু রাজ্যে। আর্থিক মন্দার কারণে ওই সব রাজ্য থেকে চিরুনির বরাত কম আসছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা। স্বাভাবিক ভাবেই কারখানায় উৎপাদন কমছে।
অতীতে জাপান থেকে চিরুনি তৈরির কাঁচামাল সেলুলয়েড আনা হত। পরবর্তী সময়ে ইতালি থেকে চিরুনি তৈরির জন্য অ্যাসিট্রেট আনা হচ্ছিল। ইতালি থেকে আনা অ্যাসিট্রেটের গুণগত মান ভাল ছিল। কিন্তু আর্থিক মূল্য অনেক বেশি পড়ে যাচ্ছিল।
সে জন্য সম্প্রতি কারখানা মালিকেরা চিন থেকে অ্যাসিট্রেট আনা শুরু করেন। তবে গুণগতমান খুব ভাল না। মহাদেব বলেন, ‘‘চিন থেকে আনা অ্যাসিট্রেট দিয়ে চিরুনি তৈরি করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, প্রচুর ছাঁট বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে লাভ কমে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়েছে। যদিও আমরা গুণগতমানের সঙ্গে আপোষ করতে পারি না। বাইরের রাজ্যে বেশি দামেও চিরুনিও পাঠাতে পারছি না। তার উপরে রয়েছে জিটএসটি। সব মিলিয়ে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।’’
মদন দাস নামে এক ব্যক্তির হরিদাসপুরে কারখানা রয়েছে। তিনি জানান, আর্থিক মন্দার ফলে ব্যবসায়ীদের হাতে নগদ কমেছে। বাজারে চিরুনির বিক্রিও কমেছে। অতীতে তাঁর কারখানায় ১৬ জন শ্রমিক কাজ করতেন। এখন রয়েছেন ৯ জন।
মালিকেরা জানালেন, কয়েক বছর ধরে বনগাঁর চিরুনি শিল্পে মন্দা চলছিল। নোট বাতিল ও আর্থিক মন্দার পর থেকে শিল্পের হাল খুবই খারাপ। এক মালিকের কথায়, ‘‘অতীতে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে যশোর চিরুনির (বনগাঁয় তৈরি চিরুনি) ভাল চাহিদা ছিল। কিন্তু এখন ওই সব রাজ্যে প্লাস্টিকের চিরুনির চাহিদা বেড়েছে। ওই চিরুনিগুলির দামও কম।’’ এক মালিক জানান, কয়েক বছর আগেও মাস গেলে প্রায় ৩২ হাজার টাকা আয় করতেন। তখন শ্রমিকেরও অভাব ছিল না। কিন্তু নোট বাতিল ও আর্থিক মন্দার পর থেকে শ্রমিক পাচ্ছেন না। রোজগারও কমেছে।
সব মিলিয়ে বিশ্বকর্মা পুজো এ বার ম্লান বনগাঁর চিরুনি শিল্পীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy