শ্রীরামপুর আদালতের দেওয়ানি বিচারকের (সিনিয়র ডিভিশন) এজলাসের সামনে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা। ছবি: দীপঙ্কর দে।
কলকাতা থেকে শ্রীরামপুর বড়জোর ২৫ কিলোমিটার। আর আইনজীবীরা বেঁকে বসায় শ্রীরামপুর আদালতের জট কাটতে লেগে গেল দীর্ঘ ৫২ দিন। কলকাতা হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে শুক্রবার আবার কাজ শুরু হয়েছে শ্রীরামপুর আদালতের দেওয়ানি বিচারক (সিনিয়র ডিভিশন) মন্দাক্রান্তা সাহার এজলাসে।
বিচারক সাহার বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তুলে এবং তাঁর বদলির দাবিতে ওই এজলাস বয়কট করছিল আইনজীবীদের যৌথ সংগ্রাম কমিটি। তাদের বয়কটে নাজেহাল হচ্ছিলেন বিচারপ্রার্থীরা। ইচ্ছুক আইনজীবীরাও ওই এজলাসে ঢুকতে পারছিলেন না আন্দোলনকারীদের চাপে। বিচারক সাহা হাইকোর্টকে বিষয়টি জানানোর পরেও আন্দোলন ওঠেনি। উল্টে আন্দোলনের ৫০ দিন উদ্যাপন করতে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলেন আন্দোলনকারীরা। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট বৃহস্পতিবার কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে। ওই দিনই বিচারপতি প্রণব চট্টোপাধ্যায় ও বিচারপতি নিশীথা মাত্রেকে শ্রীরামপুর আদালতে পাঠান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর। দুই বিচারপতির হস্তক্ষেপে আইনজীবীদের বয়কট আন্দোলন উঠে যায়।
তবে বিচারক সাহার এজলাসে ফের কাজ শুরু করার জন্য কিছু শর্ত দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। তাই আন্দোলন উঠলেও বিচারকের সঙ্গে আন্দোলনকারী আইনজীবীরা কতটা সহযোগিতা করেন, তা নিয়ে সন্দেহ একটা ছিলই। তবে শুক্রবার সকাল থেকেই ছন্দে ফেরে ওই এজলাস। আইনজীবীদের চেনা ব্যস্ততা চোখে পড়ে। বেলা ১১টা নাগাদ ওই এজলাস থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে আইনজীবী সৌমিত্র মুখোপাধ্যায় বললেন, “ঘটনাচক্রে বয়কটের দিনগুলোয় আমার কোনও মামলার শুনানি পড়েনি। তবে এ দিন শুনানি না-হলে খুবই সমস্যায় পড়তাম।”
আইনজীবীদের ওই এজলাস বয়কটের ব্যাপারটা কি মন থেকে মানতে পেরেছিলেন সৌমিত্রবাবু?
ওই আইনজীবীর সতর্ক জবাব, “এ ব্যাপারে মন্তব্য করব না। এটুকু বলতে পারি, আমি মামলা করতে ভালবাসি।” ওই এজলাসে এ দিন সওয়াল করা আইনজীবীদের অনেকেই বয়কট আন্দোলন নিয়ে মন্তব্য বা মতামত এড়িয়ে গিয়েছেন। এক আইনজীবীর মন্তব্য, “আমরা সকলেই বারের সদস্য। তাই যা বলার, তা বারের পক্ষ থেকেই বলা হবে।”
মহম্মদ মুশা মল্লিকের মতো অনেক আইনজীবীই অবশ্য মুখ খুলেছেন। ওই সরকারি আইনজীবী বলেন, “বয়কট উঠে যাওয়ায় ভাল লাগছে। বিচার চাইতে এসে লোকজন ফিরে যাবেন, এটা ঠিক নয়। কোর্ট সুষ্ঠু ভাবে চলুক।” এক সরকারি আইনজীবীর মন্তব্য, এক জন মহিলা বিচারককে বদলির দাবিতে কৌঁসুলিরা ক্রিকেট খেলছেন, কাগজে এই ছবি বেরোলে আইনজীবীদের ভাবমূর্তি নিশ্চয়ই ভাল হয় না! “এ বার স্বস্তি ফিরল,” স্পষ্টতই আশ্বস্ত দেখিয়েছে ওই সরকারি আইনজীবীকে। আর ফৌজদারি মামলার এক জুনিয়র আইনজীবী বলেন, “বয়কটের পিছনে সকলের সমর্থন নিশ্চয়ই ছিল না। বয়কটের ফলে আমাদের মক্কেলরাই তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।” শ্যামল মুখোপাধ্যায় নামে এক বিচারপ্রার্থী বলেন, “দেরিতে হলেও হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে সমস্যা মিটল। এ বার নিশ্চয়ই মামলার গতি ত্বরান্বিত হবে।”
টানা ৫২ দিনের বয়কটে সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা কী ভাবে হয়রান হয়েছেন, ফের এজলাস চালু হওয়ার দিনে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় কয়েক জন ভুক্তভোগীর বয়ানে। ভদ্রকালী থেকে অশোক মুখোপাধ্যায় নামে এক বৃদ্ধ এ দিন এসেছিলেন পারিবারিক সম্পত্তি ভাগবাঁটোয়ারা সংক্রান্ত মামলার শুনানির জন্য। তাঁর কথায়, “বয়কট উঠল, এটা সাধারণ মানুষের পক্ষে মঙ্গল। এত দিন আন্দোলনের নামে যা হল, সমর্থন করতে পারছি না।” ডানকুনির বাসিন্দা ইন্ডিয়া জুট মিলের প্রাক্তন শ্রমিক মহম্মদ সুলতান বলেন, “গত দেড় মাসে বেশ কয়েক বার আদালতে এসেছি গাড়ি-ভাড়া দিয়ে। দেখেছি, উকিলবাবুরা কাজ করছেন না। প্রতি বারেই ফিরে যেতে হয়েছে। উকিলবাবুরা কাজ বন্ধ করে ধোঁকা দিয়েছেন। এ বার মামলার কাজ হলে বাঁচি!” এফিডেভিট করাতে এসেছিলেন বৈদ্যবাটীর বাসিন্দা অর্পিতা দাস। তিনি বললেন, “রোজই কাগজে দেখেছি, কী ভাবে একটি এজলাস অচল হয়ে রয়েছে! কর্মক্ষেত্রে ক্ষোভ-বিক্ষোভ নিয়ে আইনজীবীরা আন্দোলন করতেই পারেন। কিন্তু মানুষকে বিচার পাইয়ে দেওয়াই তো ওঁদের কাজ। সেই জনতাকে বিপাকে ফেলে কাজ বন্ধ করে আন্দোলন কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এমনটা যেন আর কোথাও না-হয়।”
বয়কট তুলে নিয়ে কী বলছেন আন্দোলনকারী আইনজীবীরা?
যৌথ সংগ্রাম কমিটির মুখপাত্র রঞ্জন সরকার জানান, হাইকোর্টের দুই বিচারপতি সম্মান রক্ষার্থেই কিছু দিনের জন্য আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছে। আইনজীবীরা ওই এজলাসে ঢুকছেন। সুষ্ঠু ভাবে নিজের কোর্ট চালানোর দায়িত্ব তো মাননীয়া বিচারকেরও। তিনি যোগ করেন, “বিচারপতি নিশীথা মাত্রে এবং বিচারপতি প্রণব চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, আমাদের দাবি বিবেচনা করবেন। করছেনও নিশ্চয়ই।”
কিন্তু দুই বিচারপতির আগেও তো জেলা বিচারক, হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার এসে বয়কট তুলে নেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন। তখন আন্দোলন তোলা হয়নি কেন?
“আগে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা একই কথা বলেছিলেন কি না, বলতে পারব না। তবে বৃহস্পতিবার দুই বিচারপতির কথায় যে-আশ্বাস পাচ্ছি, সেই আশ্বাস আগের কোনও বৈঠকে পাইনি,” বললেন রঞ্জনবাবু। আর নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক বার লাইব্রেরির এক কর্মকর্তা বলেন, “বিচারকদের সঙ্গে আইনজীবীদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত। এখানে তা হচ্ছিল না। তবে হাইকোর্ট যথাসময়ে হস্তক্ষেপ করেছে। ফলপ্রসূ আলোচনার এই সুযোগ আমরা আগে পাইনি।”
আন্দোলনকারী কৌঁসুলিরা যা-ই বলুন, অনেক বিচারপ্রার্থীই আদালতে চিঠি দিয়ে বয়কট তোলার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছেও এই নিয়ে চিঠি লিখেছেন একাধিক বিচারপ্রার্থী। বয়কট ওঠায় তাঁরা যে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন, এ দিন আদালত-চত্বরের হাওয়ায় ছিল সেই স্বস্তির ছোঁয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy