মেঘে ঢাকা বহরমপুর। শনিবার। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
বাদলা মেঘ ঢের দেখেছে মুর্শিদাবাদ। বানভাসির স্মৃতিও উস্কে ওঠে প্রতি বর্ষায়। আর দেখেছে আঁধার করা ঝড়, ছাব্বিশ বছর আগে, গোকর্ণের সেই দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া চেহারাটা এখনও মনে আছে এ জেলার। তা হলে এ বারও? ফণীর ফনায় সে আশঙ্কাটাই ফিরে এসেছিল। কিন্তু তলে তলে প্রযুক্তি যে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে তা টেরই পাননি গ্রামবাসীরা। আগাম খবরে দুয়ারে খিল তোলার মতোই ঝাঁপিয়ে পড়া প্রশাসনের উদ্যোগটাও ছিল চোখে পড়ার মতো। মার্কিন মুলুকের সংবাদমাধ্যম থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জের হাততালি— সবই তাই কুড়িয়ে নিয়েছে বিভিন্ন প্রশাসন এবং সরকারি দফতরগুলি। সরকারি বিভাগের ছুটি বাতিল করে, মাত্র ঘণ্টা চারেকের যুদ্ধকালীন তৎপরতায়, ফণী-প্রচার, গ্রামের কাঁচা ঘরের মানুষকে পড়শির পাকা ঘরে সরিয়ে দেওয়া, স্কুলের পাকা বাড়ি কিংবা ফ্লাড শেল্টারে পৌঁছে দেওয়া দুঃস্থদের, ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া ত্রাণ— কর্তারা বাকি রাখেনি কিছুই। তারই ফল, ফণীকে রুখে দেওয়া।
তবুও কিছু ক্ষতি
আশঙ্কা মিথ্যে হলে কার না ভাল লাগে! শনিবার ভোরে স্বস্তির শ্বাস ফেলে নবাবের জেলার অনেকেই বলেছেন, ‘‘জোর বাঁচা গেল, মশাই! তবে খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম।’’ গত কয়েক দিন ধরে নাগাড়ে সংবাদমাধ্যমে প্রচার ও সতর্কতা চলছিল। শুক্রবার দুপুরে জানা গিয়েছিল, এ রাজ্যে ঢোকার পরে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের উপর দিয়ে ‘ফণী’ যাবে বাংলাদেশ। ফলে আগাম সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু ‘ফণী’ ক্রমশ শক্তি খুইয়ে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ হয়ে চলে যায় বাংলাদেশ। মুর্শিদাবাদে তেমন ঝড় না হলেও বৃষ্টি হয়েছে। কিছু কাঁচা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, মুর্শিদাবাদে ৫৮টি কাঁচা বাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৭৭টি কাঁচা বাড়ির আংশিক ক্ষতি হয়েছে। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩২ লক্ষ ৬৭ হাজার ৯০০ টাকা। জেলা প্রশাসনের দাবি, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে জেলায় বিভিন্ন এলাকায় ১১২টি ফ্লাড ও রেসকিউ শেল্টারে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে আনা হয়েছিল। শনিবার সকালে তাঁরা অবশ্য বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। জেলাশাসক পি উলাগানাথন বলেন, “ফণী নিয়ে মুর্শিদাবাদে আর কোনও আশঙ্কা নেই।”
নিরাপদ আশ্রয়ে
ওড়িশায় ফণীর বিধ্বংসী চেহারা দেখে সিঁটিয়েছিল মুর্শিদাবাদও। বার বার টিভির চ্যানেল বদলে, ইন্টারনেট ঘেঁটে সকলেই দেখে নিতে চেয়েছেন ফণীর অবস্থান কোথায়। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, সারা জেলা জুড়ে তিন হাজার চার জন ফণীর আতঙ্কে ঘর ছেড়ে জেলার ৬৪টি বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বহরমপুর ব্লকে সেই সংখ্যাটা হাজার খানেক বলে জানা গিয়েছে।
বহরমপুরের বিডিও রাজর্ষি নাথ জানিয়েছেন, বহরমপুর ব্লকের ১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় কোনও ফ্লাড শেল্টার না থাকায় লোকজন বেশ কিছু স্কুলবাড়িগুলিতে রাতে আশ্রয় নিয়েছিল। কিছু লোকজন মাটির বাড়ি ছেড়ে পড়শির পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফণীর দাপটে জিয়াগঞ্জে বৃষ্টি শুরু হলেও সেই সময় নিরাপদ আশ্রয়ে সে ভাবে লোকজন যাননি। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ে ভিড় জমাতে থাকেন গঙ্গা পাড়ের লোকজন। চারটি নিরাপদ আশ্রয়স্থলে মোট তেরোশো জন আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে পুরসভা সূত্রে খবর। শুক্রবার রাতে কোথাও খিচুড়ি, ডিমের তরকারি, কোথাও ভাত, ডাল, ডিমের ঝোল খাওয়ানো হয়েছে।
সুনসান শহর
ফণী চলে গিয়েছে বাংলাদেশে। বহরমপুর পুরসভা সব রকমের আপৎকালীন ব্যবস্থা নিলেও শহর এলাকায় বৃষ্টি ছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা টিম ও অন্য বিভাগের কোনও দরকার হয়নি বলে পুরসভার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বহরমপুরের বেশ কিছু নিচু এলাকায় বৃষ্টির জল জমে গিয়েছিল।
শনিবার সকাল ১০টা নাগাদ বৃষ্টি ছেড়ে যায়। তার পরেও বহরমপুর শহর এ দিন ছিল সুনসান। যে শহরে টোটোর ভিড়ে পথ চলা দায়, এ দিন রাস্তায় টোটোর সংখ্যা ছিল অনেক কম। বহরমপুর রেলস্টেশনেও লোকজন কম ছিল। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও যাত্রীর সংখ্যা অনেক কম ছিল বলে রেল সূত্রে জানা গিয়েছে।
অন্য দিনের মতো ভিড়ে ঠাসা মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগেও এ দিন রোগীর সংখ্যা অনেক কম ছিল বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের সুপার দেবদাস সাহা। বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডও ছিল বেশ ফাঁকা। যাত্রী সংখ্যাও কম ছিল। অরঙ্গাবাদের কিছু এলাকাতেও জল জমেছিল। সুতি ২ পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি মহম্মদ মাসুদুল হক জানান, টানা বৃষ্টির জন্য বাজার-হাট বসেনি। ফলে এলাকায় বিড়ি শ্রমিকেরা সমস্যায় পড়েছেন।
ফলে সুফল
ফণীর জেরে মুর্শিদাবাদে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে ভেবে কৃষকদের সতর্ক করতে আগেই মাঠে নেমেছিল কৃষি দফতর। তবে শেষ পর্যন্ত তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ায় স্বস্তিতে কৃষক, কৃষি ও উদ্যান পালন দফতর। কৃষি ও উদ্যান পালন দফতরের দাবি, জেলায় শুধু বৃষ্টি হয়েছে, ঝড় হয়নি।
কৃষকদের দাবি, এই বৃষ্টির জেরে পাকা ধান কাটার সময় অন্ততপক্ষে এক সপ্তাহ পিছিয়ে গেল। টানা বৃষ্টির জেরে মাটি নরম হওয়ায় আনাজ -সহ কিছু মাচা পড়ে গিয়েছে। নিচু জমিতে জল জমে যাওয়ায় ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কাটা ধান শীঘ্র ঘরে তুলতে না পারলে ক্ষতি
হতে পারে।
তবে কৃষি দফতরের কর্তাদের দাবি, এখনও পর্যন্ত ক্ষতির খবর নেই। মাঠ পরিদর্শন করে দফতরের আধিকারিকদের রিপোর্ট পাঠাতে বলা হয়েছে। মুর্শিদাবাদের উপ কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) তাপসকুমার কুণ্ডু বলেন, ‘‘গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় গড়ে ৭১.৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। পূর্বাভাস থাকলেও ঝড় হয়নি। ফলে জেলায় ফসলের কোনও ক্ষতি হয়নি।’’
জেলা উদ্যান পালন দফতরের উপ অধিকর্তা গৌতম রায় বলেন, ‘‘শুধুমাত্র বৃষ্টি হওয়ায় ফসলের ক্ষতি হয়নি। বরং এই সময় আম ও লিচুতে জলের দরকার ছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তাতে আম, লিচু, কাঁঠাল, কলা চাষের ভাল হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy