উফ্, মনে পড়লে এখনও শিউরে উঠছি মশাই!
ডোমকলের ওই ভোট-কথা সারা জীবন মনে থাকবে। ভোটের আগের রাত থেকে শুরু হয় বোমাবাজি। মাঝেমধ্যেই পিলে চমকানো সেই আওয়াজ। একেই অচেনা জায়গা। ঘুম আসছে না। তার উপরে নাগাড়ে বোমার শব্দে রাতভর দু’চোখের পাতা এক করতে পারনি। মাঝে-মাঝেই বিছানা ছেড়ে উঠে দেখেছি, আমাদের সঙ্গে আসা কেন্দ্রীয় বাহিনীর চার জন জওয়ান আছে তো! ভোটের আগের রাতেই যদি এই দশা হয়, ভোটের দিন তাহলে কী হবে! ভাবতে ভাবতেই রাত কেটে ভোর।
এর আগে ন’বার ভোট করেছি। কিন্তু এ বছর প্রথম পোলিং অফিসার হিসেবে ভোটের দায়িত্বে ডোমকল যেতে হয়েছিল। ডোমকল শুনেই প্রথম থেকেই একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম। ঘটনাস্থলে পৌঁছে বুঝতে পারলাম ভয়টা একেবারেই অমূলক ছিল না। গত ২০ এপ্রিল সকালে বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ছাড়ার কথা ছিল। সেই মতো সকাল সাড়ে ৮টা’র মধ্যে সেখানে পৌঁছে যায়। কিন্তু সময়ের মধ্যে জেলা প্রশাসন বাসের কোনও বন্দোবস্ত করতে পারেনি। তা নিয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধও করেন অনেক ভোটকর্মী। কিন্তু আমরা কয়েক জন ১৮০০ টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে ডোমকলে পৌঁছয়। আমার গন্তব্য ছিল ৬০ নম্বর শীতলনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২১৯ নম্বর বুথ। ওই স্কুলে কোনও পাঁচিল ছিল না। স্কুলের পিছনে বাগান। শৌচাগার নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু নলকূপ দূরে থাকায় জল আনার ক্ষেত্রে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়েছিল।
এ দিক বোমার আওয়াজে জাগরণে বিভাবরী গিয়েছে। ভোর সাড়ে চারটেয় উঠে স্নান সেরে নিই। সকাল ছ’টার মধ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে তৈরি হয়ে যাই। ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে যায় সকাল ৭টা থেকে। শীতলনগর গ্রামটি শান্ত হলেও তার পাশেই রয়েছে কুপিলা গ্রাম। ফলে গণ্ডগোলের আশঙ্কা করে স্কুলের পিছনের দিকের বাগানে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে রাখা হয়। তবে ভোট চলাকালীন কোনও গণ্ডগোল হয়নি ঠিকই, কিন্তু শুরু থেকেই খুব ধীর গতিতে ভোট দেওয়ার কাজ চলছিল।
তার পিছনের কারণ ওই বুথে এক জনের ভোট অন্য জনের দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এক জন নবদম্পতি ভোট দিতে এসে ছিলেন। স্বামীর দাবি, স্ত্রী-র হয়ে তিনি ভোট দেবেন। স্ত্রী অবশ্য নিজের ভোট নিজে দিতে আগ্রহী। কিন্তু স্বামী দিতে দেবেন না। একই ভাবে ছেলে এসে বলছেন, তিনি তাঁর মায়ের ভোট দেবেন। আবার দেখে মনে হচ্ছে সুস্থ যুবক কিন্তু পরিবারের লোকজনের দাবি তিনি নাকি মানসিক ভারসাম্যহীন। ফলে ওই যুবকের হয়ে ভোট পরিবারের লোকজন দিতে চেয়েছেন।
কয়েক জনের ভোটারের দাবি তাঁরা চোখে দেখতে পান না। ফলে তাঁর হয়ে অন্য জন ভোট দেবে। আবার এমন অনেকে এসেছিলেন, যাঁরা এর আগে কোনও দিন ভোট দেননি। তখন তাঁদেরকে ওই বুথের মধ্যে নকল ইভিএম দেখিয়ে কী ভাবে ভোট দিতে হবে তা শেখানো হয়। ওই সব সমস্যা মেটাতে ভোট ধীর গতিতে চলছিল।
এক জনের ভোট অন্য জন দেওয়ার বিষয়ে পোলিং এজেন্টদের মধ্যেও অদ্ভূত বোঝাপড়া দেখলাম। তাই নিয়ে ভোটকর্মীদের সঙ্গে পোলিং এজেন্টদের বচসা থেকে তর্কাতর্কি পর্যায়ে গড়িয়েছে। সকাল ১১টা নাগাদ রাজনৈতিক দলের পোলিং এজেন্টদের কাছ থেকে জানতে পারি ভোট দিতে এসে খুন হয়ে গিয়েছে এক জন। তাই শুনে আতঙ্ক বুকের মধ্যে চেপে বসে। তার পরেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভোট শেষ করার দিকে নজর যায় সকলের। ওই খবর শোনার পরেই ভোট পড়ার গতিও বেড়ে যায়। আমার ওই বুথে ৯৪১ জন ভোটার থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভোট দেন ৮৭৬ জন।
পরে ভোটপর্ব মিটিয়ে ডোমকল মহকুমা প্রশাসনিক ভবনে যাবতীয় নথিপত্র জমা দেওয়ার সময়েও বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। সেখানেই রাত সাড়ে ১১টা বেজে যায়। ফের নিজেদের গাঁটের টাকা খরচ করে গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি ফিরে আসি ওই রাতেই। ভোট মিটে গিয়েছে ১০ দিন হল। কিন্তু মুর্হূমুর্হূ বোমা ফাটার শব্দ এখনও কানে বাজে। রাতে ঘুমের চটকা কেটে যাচ্ছে বোমার ফাটার শব্দে। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসি। বোমা ফাটার শব্দ পিছু ছাড়ছে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy