কোচবিহারে আচমকা আগ্নেয়াস্ত্রের এত রমরমার জন্য কি শাসকের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই দায়ী? গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
আজ থেকে পনেরো-কুড়ি বছর আগে ‘ডাকাত’ ও ‘মস্তান’দের স্বর্গরাজ্য ছিল কোচবিহার। কান পাতলে এখনও সে সব গল্প ঘুরে বেড়ায় শহর-গ্রামের আনাচে-কানাচে। নামকরা ডাকাতদের নামও ঘুরে বেড়ায়। তেমনই ছিল শহরের কিছু ‘মস্তান’। তাদের কারও কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকত। যা মূলত ‘ওয়ান সটার’ বা ‘পাইপগান’। শোনা যায়, রাতের অন্ধকারে গৃহস্থকে ভয় দেখাতে মান গাছের ডাটা কালো রং করে ‘রাইফেল’ বানাত ডাকাতরা। এই দুই দশকে যেন পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে কোচবিহার। পাইপগানের জায়গা নিয়েছে অত্যাধুনিক পিস্তল। মান গাছের ডাটার নকল বন্দুকের জায়গা নিয়েছে আসল স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। পাড়ার ছিঁচকে চোর থেকে রাজনৈতিক দলের লোকজন, সকলের চারদিকেই এমন বন্দুকের গন্ধ।
সম্প্রতি এক তৃণমূল নেতার ছবি ফেসবুকে ঝড় তোলে। তিনি হাতে কারবাইন নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এবং বেশ গর্বিত ভঙ্গীতে। সে গোলমাল মিটতে নাম মিটতেই আর এক তৃণমূল নেতার সঙ্গীকে দেখা গেল তাঁর পাশে বসে, হাতে অত্যাধুনিক পিস্তল!
রাজ্যের একটি প্রত্যন্ত জেলা, মূলত কৃষিকাজের উপরে নির্ভরশীল কোচবিহারে আচমকা আগ্নেয়াস্ত্রের এত রমরমা কেন?
পুলিশি তদন্তেই উঠে এসেছে, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকে এখন পর্যন্ত ৬০টি আগ্নেয়াস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। গ্রেফতারও হয়েছে বহু। তার মধ্যে হাতে গোনা দু’-একজন দাগী দুষ্কৃতী। বাকিরা প্রত্যেকেই রাজ্যের শাসক দলের নেতা-কর্মী। এমনকী, বন্ধুকবাজদের হামলায় খুনের প্রায় প্রতিটি ঘটনায় শাসকদলের নেতা-কর্মীরাই গ্রেফতার হয়েছেন। আগ্নেয়াস্ত্র ও খুনের মামলায় এখন বিচারাধীন বন্দির তালিকায় আছেন তৃণমূল নেতা মহম্মদ কলিম খান ওরফে মুন্না থেকে শুরু করে দিনহাটার বড় আটিয়াবাড়ির তৃণমূল নেতা নরেশ বর্মণ। তাঁকে স্টেনগান-সহ গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
পুলিশের একাংশের দাবি, পুরসভা থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় দলের রাশ কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই তীব্র হয়ে উঠেছে। তাতেই বেড়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের চাহিদা। দিনহাটা, সিতাই থেকে শুরু করে কোচবিহারের দেওয়ানহাট, পানিশালা, চান্দামারি, পুন্ডিবাড়ি, কোচবিহার শহরের আনাচে-কানাচে এই অস্ত্রের চাহিদা তাই বেড়ে গিয়েছে। কারবারিরাও এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে, কোচবিহারে সব থেকে বেশি চাহিদা নাইন এমএম ও সেভেন এমএম পিস্তলের। পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকায় ওই পিস্তল বিক্রি হচ্ছে। এই আগ্নেয়াস্ত্র আবার খুলে আলাদা করেও রাখা যায়। পুলিশের চোখকে ধুলো দিতে এমন ভাবেই তৈরি হয়েছে ওই পিস্তল।
এক তদন্তকারী অফিসার জানান, কোচবিহারে মূলত বিহারের মুঙ্গের থেকে অস্ত্র আসে। জেলার নির্দিষ্ট দুই-একটি জায়গায় কিছু দুষ্কৃতী পাইপগান বা ওয়ান সটার তৈরি করে। ওই পিস্তলের দাম ৫-১০ হাজার টাকা। তবে অত্যাধুনিক পিস্তলে কোচবিহারের ভরসা সেই মুঙ্গের। অসমের জঙ্গি কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত একটি চক্র ইদানীং কোচবিহারে অস্ত্র সরবরাহ করে থাকতে পারে বলেও সন্দেহ পুলিশের। দু-একটি স্টেনগান ও নাইন এমএম পুলিশের হাতে এসেছে, যা মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গি সংগঠন ও অপরাধীরা ব্যবহার করে। তাতে সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে। কোচবিহারের পুলিশ সুপার ভোলানাথ পাণ্ডে বলেন, “বিশেষ দল তৈরি করে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তদন্ত অনেকটা এগিয়েছে। শীঘ্রই আরও গ্রেফতার হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy