পুরসভার জল পর্যাপ্ত নয়। মাটি খুঁড়েও জল সংগ্রহ ১ নম্বর ওয়ার্ডে। — নিজস্ব চিত্র।
জল প্রকল্প থাকলেও পুরভোটের মুখে জল নিয়েই সরগরম রঘুনাথপুর শহরের রাজনীতি। পুরসভায় গত দশ বছর ক্ষমতায় থাকা তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অন্যতম হাতিয়ার এই জল। প্রচারে বিরোধী দলগুলি বলছে, এক দশক ক্ষমতায় থেকেও রঘুনাথপুরের জলের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারল না রাজ্যের শাসকদল। আর বিরোধীদের প্রচারের জবাবে তৃণমূল বলছে, তারাই শহরে পুরসভার জন্য পৃথক জল প্রকল্প তৈরি শুরু করেছে। কিছু সময় পেলে সেই প্রকল্প চালু করে দেওয়া সম্ভব হত। তবে গরমে পুর-এলাকায় জল সঙ্কট শুরু যাওয়ায় নাগরিকদের বক্তব্য, জল নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করে ওই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দলগুলি উদ্যোগী হলে ফি-বছরের মত এ বারেও জল সঙ্কটে তাঁদের ভুগতে হত না।
এমনিতে পুরুলিয়া বা ঝালদা পুর-এলাকার তুলনায় রঘুনাথপুরে জলের সঙ্কট অনেকটাই কম। সৌজন্যে, ইন্দো-জার্মান জল প্রকল্প। প্রায় বারো বছর আগে শুরু হওয়া এই জল প্রকল্পের কারণেই রঘুনাথপুর শহরে জলের তীব্র সমস্যা নেই। এরই পাশাপাশি প্রায় তিন বছর আগে রঘুনাথপুর শহরের জন্য পৃথক জল প্রকল্প তৈরি করছে পুরসভা। কেন্দ্রীয় সরকারের বিআরজিএফ(স্পেশ্যাল) প্রকল্প থেকে বরাদ্দ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকা। কাজও এগিয়েছে অনেকটা। কিন্তু, এই প্রকল্প থেকে জল সরবরাহ শুরু হয়নি। আর ভোটের মুখে এটাকেই শাসকদলের বিরুদ্ধে প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার করছে বিরোধীরা।
পুরসভা সূত্রের খবর, প্রকল্পটিকে ‘জোন ওয়ান’ ও ‘জোন টু’—এই দু’ভাগে ভাগ করে কাজ করা হচ্ছে। রঘুনাথপুরে চেলিয়ামা রাস্তার পাশে ও নন্দুয়াড়ায় জয়চণ্ডী পাহাড়ের পাদদেশে দু’টি রিজার্ভার তৈরি করা হয়েছে। জোন ওয়ানের চেলিয়ামা রাস্তার রিজার্ভার থেকে জল সরবরাহ করা হবে ১,২,৩,৪,১৩ ওয়ার্ডগুলির পুরোটা এবং পাঁচ ও ছয় দুটি ওয়ার্ডের একাংশে। জোন টু থেকে জল সরবরাহ করা হবে বাকি ওয়ার্ডগুলিতে। জোন ওয়ানের কাজ প্রায় শেষের মুখে। জোন টু-এর ক্ষেত্রে কাজ কিছুটা বাকি আছে। জল সরবরাহের জন্য শহর জুড়ে পাইপ পাতার কাজও প্রায় শেষ। এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্পের ১০ কোটি টাকা হাতে পেয়ে খরচ করেছে পুরসভা।
এই জল প্রকল্পের কাজ পুরভোটের আগে শেষ করে দিতে পারলে তাঁরা নির্বাচনে বাড়তি ফায়দা পেতেন বলে মনে করছেন শাসকদলের নেতা-কর্মীরা। কারণ, গরমের শুরুতেই জল সঙ্কট শুরু হয়ে গেছে শহর জুড়ে। রঘুনাথপুরের বিদায়ী পুরপ্রধান মদন বরাট স্বীকার করে নিচ্ছেন শহরের ১, ৩, ১৩—এই ওয়ার্ডগুলির একাংশে জলের সমস্যা যথেষ্ট। বিরোধীদের অবশ্য দাবি, নন্দুয়াড়ার অংশটি বাদ দিয়ে শহরের কম পক্ষে ৯টি ওয়ার্ডে জলের তীব্র সঙ্কট রয়েছে।
প্রচারে নেমে ভোটারদের কাছে জলের সমস্যাই তুলে ধরছেন ১ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী তারকনাথ পরামানিক। তিনি বলেন, ‘‘দশ বছর টানা ক্ষমতায় থেকেও তৃণমূল পরিচালিত পুরসভা রঘুনাথপুরে জলের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারল না। এটাই সব চেয়ে বড় ব্যর্থতা শাসকদলের।’’ বিজেপি-র রঘুনাথপুর শহর মণ্ডলের সম্পাদক তথা ৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী শুভঙ্কর করের দাবি, ‘‘জল প্রকল্পের পুরো ১০ কোটি টাকাই জলে গেছে! তৃণমূলের পুরবোর্ড শহরে নাগরিকদের কাছে পানীয় জল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারেনি। ’’ আর সিপিএমের রঘুনাথপুর লোকাল কমিটির সম্পাদক লোকনাথ হালদার বলেন, ‘‘বামফ্রন্টের সময়ে ইন্দো-জার্মান জল প্রকল্প শুরু হয়েছিল। কিন্তু এই প্রকল্পটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে পুরসভা ব্যর্থ হওয়াতেই জলের সমস্যা তৈরি হয়েছে শহরে। পুরসভা সেদিকে নজর না দিয়ে নতুন করে জলপ্রকল্প করছে।” তাঁর আরও দাবি, এই জলপ্রকল্পে কোথা থেকে জলের সংস্থান হবে, সেটাই স্থির না করে নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি জলপ্রকল্প শুরু করে দিতে উদ্যোগী হয়েছে তৃণমূলের বিদায়ী পুরবোর্ড।
ঘটনা হল, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের পরিচালিত ইন্দো-জার্মান প্রকল্প থেকে রঘুনাথপুরে পর্যাপ্ত জল সরবরাহে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। একটি মাত্র রিজার্ভার থেকে শহরের ১৩টি ওয়ার্ডের প্রায় দেড় হাজার বাড়ির পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে পাঁচ-ছটি স্ট্যান্ড পোস্টের মাধ্যমে জল দেওয়া হয়। আবার এই রিজার্ভার থেকেই জল যায় মহকুমা হাসপাতালে। কিন্তু, গত এক দশকে শহরের জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে ও অপরিকল্পিত ভাবে বাড়িতে, দোকানে নতুন জলের সংযোগ দেওয়াতে জল সঙ্কট ক্রমশই বাড়ছে এই পুরশহরে। গরমের সময়ে জলস্তর নেমে যাওয়ায় টিউবয়েল থেকেও পর্যাপ্ত জল মেলে না। ফি বছর গরমের শুরুতেই তাই জল সঙ্কট দেখা দেয় শহরের বিভিন্ন এলাকায়।
এই অবস্থায় এ বছর ভোটের আগে নতুন জল প্রকল্প শুরু করে দিতে পারলে নিঃসন্দেহে বাড়তি ফায়দা পেত শাসকদল। মদনবাবু বলেন, ‘‘পাইপ লাইন পাতার জন্য পূর্ত দফতর পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক খোঁড়ার অনুমতি দিলে জল সরবরাহ শুরু করা যেত। আমরা সেই কাজের অনুমতি চেয়েও পায়নি।’’ যা শুনে বিরোধীদের কটাক্ষ, শহরবাসীকে জল দিতে না পেরে এখন যুক্তি সাজাচ্ছেন বিদায়ী পুরপ্রধান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy