Advertisement
E-Paper

কোথা থেকে এল বড়দিন আর সান্তা ক্লস

রোমানরা মহাসমারোহে পালন করতেন ‘স্যাটারনালিয়া’। উপাসনা, খানাপিনা, নাচ-গান-নাটকে ভরপুর এই উৎসব ক্রিসমাসে সঞ্চারিত হয়।নানা রঙের আলোয় আর কাগজের তারায় পার্ক স্ট্রিট সেজে উঠেছে, কলকাতায় আনন্দময় বড়দিন এল। অনেকেই এই দিন সাহেবপাড়ায় সন্ধেটা কাটাবেন, ধর্মপ্রাণরা সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রালে যাবেন মধ্যরাত্রির উপাসনায়। খ্রিস্টের জন্মদিনে শুরু হবে এক সপ্তাহের উত্‌সব, নিউ ইয়ার্স-এ যার শেষ।

জহর সরকার

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:৪০

নানা রঙের আলোয় আর কাগজের তারায় পার্ক স্ট্রিট সেজে উঠেছে, কলকাতায় আনন্দময় বড়দিন এল। অনেকেই এই দিন সাহেবপাড়ায় সন্ধেটা কাটাবেন, ধর্মপ্রাণরা সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রালে যাবেন মধ্যরাত্রির উপাসনায়। খ্রিস্টের জন্মদিনে শুরু হবে এক সপ্তাহের উত্‌সব, নিউ ইয়ার্স-এ যার শেষ।

কিন্তু যিশুখ্রিস্ট কি সত্যই এই দিনটিতে জন্ম নিয়েছিলেন? কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত না করে আমরা সংক্ষেপে ইতিহাসটা খতিয়ে দেখব। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে খ্রিস্টজন্মের নির্দিষ্ট সাল-তারিখের উল্লেখ নেই, ফলে গোড়া থেকেই এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা ও তর্কবিতর্ক শুরু হয়। ডেল আরভিন ও স্কট সানকিস্ট তাঁদের বিশদ গবেষণার ফসল হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ক্রিশ্চিয়ান মুভমেন্ট গ্রন্থে লিখেছেন, ‘৩০০ খ্রিস্টাব্দের আগে যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন বিষয়ে খ্রিস্টানদের মধ্যে কোনও ঐকমত্য ছিল না। অনেকে বসন্তের একটি দিনকে এই উদ্দেশ্যে মানতেন, অনেকে আবার ‘অদম্য সূর্যের দিন’ ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে পালন করতেন। ক্রমশ অধিকাংশ খ্রিস্টান এই তারিখটিকেই মেনে নিলেন, তার ফলে খ্রিস্টীয় আচারে ‘সলস্টিস’ বা অয়নকাল-এর সূর্যবন্দনার সঙ্গে ‘স্যাটারনালিয়া’ নামক রোমান উত্‌সবের একটা মিলন ঘটল। হোমার স্মিথ তাঁর ম্যান অ্যান্ড হিজ গডস-এ লিখেছেন, ‘২৫ ডিসেম্বরের এই স্থানীয় উত্‌সব গ্রিক সৌর উত্‌সব ‘হেলিয়া’র সঙ্গে মিশে গেল, এই উত্‌সবের মধ্যে দিয়ে অ্যাটিস, ডায়োনিসাস, ওসিরিস প্রমুখ দেবতাকেও সম্মান জানাল, ‘পৃথিবীর আলো’ ও ‘পরিত্রাতা’ নামেও তাঁরা পূজিত হলেন।’ ডিসেম্বরের ২১-২২ তারিখে সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়, ঠান্ডায় জমে যাওয়া ইউরোপের মানুষের কাছে বছরের কঠিনতম সময়ের অবসান ঘটে, বাকি শীতটা পার করে দেওয়া যাবে— এই স্বস্তি থেকেই শীতের উত্‌সব এসেছিল।

খ্রিস্টপূর্ব যুগের এই দারুণ জনপ্রিয় উত্‌সবের সঙ্গে দিন মিলিয়ে রোমান চার্চ ২৫ ডিসেম্বরকে খ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে মেনে নিলেও ৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি পূর্ব গোলার্ধের চার্চগুলি তাতে সায় দেয়নি। কিছু পণ্ডিত দেখিয়েছেন, সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত জেরুসালেমের চার্চ এই দিনটিকে অগ্রাহ্য করেছে। আর্মেনিয়ানরা এখনও ৬ জানুয়ারি ক্রিসমাস পালন করেন। এই অনির্দিষ্টতায় খ্রিস্টের মহিমা এতটুকুও ক্ষুণ্ণ হয় না। গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন নিয়েও নানা মত আছে। আমরা দেখতে চাইছি, একটা মহান ধর্ম কী ভাবে ঐতিহ্য থেকে বিভিন্ন উপকরণ গ্রহণ করে তাদের সংস্কার ঘটায় এবং নিজেকে সমৃদ্ধ ও সজীব করে তোলে।

এই সূত্রে আরও নানা কৌতূহল ভিড় করে আসে। যেমন, ক্রিসমাস ট্রি কোথা থেকে এল? খ্রিস্টের জন্মভূমি জুডিয়া বা প্যালেস্টাইনের গরমে ওই ধরনের কনিফার জন্মানোর প্রশ্ন ছিল না। খ্রিস্টধর্ম যখন উত্তরে প্রসারিত হয়ে ইউরোপের ধর্মে পরিণত হয় তখনই পাইন গাছ থেকে ক্রিসমাস ট্রি-এর ধারণা জন্ম নিয়েছিল। ইউরোপে পুরনো মাতৃকাদেবীর মন্দিরে থাকত পাইন গাছের সারি। ইতিহাসে ক্রিসমাস ট্রি-এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় লাটভিয়ায় ১৫১০ ও জার্মানিতে ১৫৭০ সালে। কথিত আছে, জার্মান প্রোটেস্টান্ট মার্টিন লুথার ষোড়শ শতকে এটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ১৮৩০-এর দশকে রানি ভিক্টোরিয়ার জার্মান স্বামী অ্যালবার্ট উইন্ডসর প্যালেসে ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে আসেন, সেই থেকে ইংল্যান্ডে তার প্রচলন হয়। অতঃপর তা ব্রিটেন থেকে তার উপনিবেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং আটলান্টিক পেরিয়ে পাড়ি দেয় আমেরিকায়, যেখানে সব কিছু নিয়েই একটু বাড়াবাড়ি করা হয়ে থাকে।

নতুন খ্রিস্টধর্মকে জনসাধারণের মধ্যে আরও জনপ্রিয় করতে খ্রিস্টপূর্ব যুগের বিবিধ উপাসনার নানা প্রতীক আর আচারও এই নতুন ধর্মে বুনে দেওয়া হল। যেমন হলি গাছের পাতার সবুজ স্তবক আর লাল চেরি ও মিসলটাও দিয়ে তৈরি ক্রিসমাসের অভিজ্ঞান। ক্রিসমাস প্রবর্তনের অনেক শতাব্দী আগে এই দিনে রোমানদের বড় উৎসব স্যাটারনালিয়া পালিত হত মহাসমারোহে। উপাসনা, খানাপিনা, নাচ-গান-নাটকে ভরপুর এই উৎসবের ধারা ক্রিসমাসের মধ্যে সঞ্চারিত হল। যে সব কোম্পানি আজ হাজার হাজার কোটি টাকার ক্রিসমাস কার্ড আর গিফট-এর ব্যবসা করে, তাদের এই পুরনো রোমান উৎসবের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, কারণ ক্রিসমাসের সময় কার্ড আর উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর রীতি এই প্রাচীন উৎসব থেকে এসেছে। ক্রিসমাস পালনের বিভিন্ন প্রথা, যেমন ‘ইউল লগ’ পোড়ানো, মোমবাতি জ্বালানো, ক্যারল গাওয়া, এ সবই এসেছে বা নেওয়া হয়েছে পুরনো নানা রকম আচার থেকে।

বিশুদ্ধতাবাদী খ্রিস্টানরা এ-সব খ্রিস্ট-পূর্ব ও (তাঁদের মতে) ‘বিধর্মী’ রীতি ও আচারের মাধ্যমে ক্রিসমাস পালনকে অনেক সময়েই ‘অপবিত্র আড়ম্বর আর উল্লাস’ বলে নিন্দা করেন। পলিডোর ভার্জিল লিখেছেন, ‘খ্রিস্টানদের মধ্যে নাচানাচি, মুখোশ পরা, নাটক করা ও আরও নানা উচ্ছৃঙ্খল উপায়ে ক্রিসমাস পালনের রীতি এসেছে প্রাচীন রোমান উৎসবগুলি থেকেই, তাই ধার্মিক খ্রিস্টানরা যেন এগুলিকে চিরকালই ঘৃণা করেন।’ ক্লদিয়া দে লিস-এর মতে, সপ্তদশ শতকে ম্যাসাচুসেটস-এর পিউরিটানরা আচার অনুষ্ঠানের বাড়াবাড়ি দেখে ক্রিসমাস উৎসবকেই নিষিদ্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ক্রিসমাস কেক আর পুডিং কেবল নিজেদের লোভ মেটানোর একটা উপায়— এই অভিযোগ তুলে ১৬৬৪ সালে পিউরিটানরা তা নিষিদ্ধ করে দিতে উদ্যোগী হন। সে চেষ্টা সফল হলে পাশ্চাত্যের প্রায় সব কেক ব্যবসায়ীর কারবার লাটে উঠত। কিন্তু রাজা প্রথম জর্জ ফের ক্রিসমাসে কেক আর পুডিং-এর চল ফিরিয়ে আনলেন এবং সেই সব কেক পুডিং যেন আরও মিষ্টি হয়ে উঠল, যে মিষ্টিতে লোভে পাপ।

সান্তা ক্লস কবে এলেন? কে-ই বা তিনি? উপকথায় বলে, তিনি নাকি চতুর্থ শতকের এক অত্যন্ত দয়াবান বিশপ। তাঁর আদি নিবাস তুরস্ক, নাম ছিল নিকোলাস। তিনি দীন-দরিদ্রদের সাহায্য করতেন, বিশেষত যাঁরা মুখ ফুটে সাহায্য চাইতে পারতেন না তাঁদের। তাঁর সম্পর্কে একটি দারুণ লোককথা প্রচলিত। এক বার এক খুব গরিব মানুষের বাড়িতে তিনি চিমনি বেয়ে উঠে তার ভিতর দিয়ে কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা ফেলে এসেছিলেন। চিমনির পাশে একপাটি মোজা শুকোনোর জন্য রাখা ছিল, মুদ্রাগুলি তার মধ্যে গিয়ে পড়ে। দরিদ্র মানুষটি স্বর্ণমুদ্রাগুলি বিক্রি করে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেই থেকে সান্তার জন্য বাচ্চারা মোজা ঝুলিয়ে রেখে দেয়, তাকে উদ্দেশ করে অপূর্ব সব চিঠি লেখে আর অপেক্ষা করে, কখন সান্তা এসে দারুণ সব উপহার দিয়ে যাবে। কবিতায় গানে গল্পে আমরা জেনেছি, কেমন করে সেই সন্ত উত্তর মেরু থেকে বড় বড় শিংওয়ালা হরিণে টানা স্লেজে চেপে বরফের মধ্যে দিয়ে এসে সারা পৃথিবীর অগণিত বাচ্চাকে উপহার দিয়ে যান। ক্রিসমাসের আগের রাত্রে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়লে মা-বাবা মোজার ভেতর নানান খেলনা, উপহার রেখে সেই মোজা তাদের মাথার কাছে রেখে দেন। পরের দিন সকালে শিশু ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে সেই মোজা খুলে দেখতে যায় সান্তা তার জন্য কী উপহার রেখে গেছে— তৈরি হয় এই উত্সবের শ্রেষ্ঠ দৃশ্য।

ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে যখন নৌবাণিজ্যের প্রসার হল, তখন নাবিকরা এই সন্তের গল্প বয়ে নিয়ে গেলেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, অচিরেই তাঁর নাম হল ‘ফাদার ক্রিসমাস।’ পরে ওলন্দাজ অভিবাসীরা এই লোককথাকে আমেরিকায় নিয়ে গেলেন, তাঁদের ‘সিন্টার-ক্লাস’ হয়ে গেলেন সান্তা ক্লস। বিশাল খেলনা-শিল্প রঙবেরঙের বিজ্ঞাপন করে উত্সবের মহিমা বাড়িয়ে তুলল। অনেক দিন অবধি আমেরিকানরা সান্তা ক্লসকে তাঁদের পতাকার (স্টার্স অ্যান্ড স্ট্রাইপস) নকশা দিয়ে সাজাতেন। তার পর ১৮৮১ সালে হার্পার্স উইকলি-তে ছাপা হল সান্তার নতুন ছবি: লম্বা সাদা দাড়ি, লাল জোব্বা, নাদুসনুদুস মানুষটির হাত ভরতি খেলনা। দুনিয়া জুড়ে বাণিজ্য এবং ধর্ম অনেক সময়েই হাতে হাত মিলিয়েছে। ১৯৩১ সালে কোকা কোলা নিয়ে এল টকটকে লাল, বিশাল ‘কোক সান্তা’ বিজ্ঞাপন, আজও ক্রিসমাসের সময় যা অতিপরিচিত। এ ভাবেই গোটা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়েছে ‘জিঙ্গল বেলস’।

এই ভাবেই বেথলেহেম থেকে রোম হয়ে দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ক্রিসমাস, আর সান্তা ক্লস তুরস্ক থেকে উত্তরমেরু পাড়ি দিয়েছেন, এবং এখন তিনি অবাধে বিশ্বের সর্বত্র ঘুরে বেড়ান, পাসপোর্ট ভিসার তোয়াক্কা না করে অনাবিল আনন্দ বিতরণ করেন।

প্রসার ভারতীর সিইও। মতামত ব্যক্তিগত

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy