ভারতে ‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য’ নিয়ে আমরা অনেক কথা বলে থাকি, কিন্তু কথাটার সত্য অর্থ উপলব্ধি করতে চাইলে আমাদের কিছু নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। যেমন, এমন নানা উত্সব আছে, যেগুলির ঐতিহাসিক উত্স বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম, অথচ অনেক জায়গাতেই যেগুলি বছরের কোনও একটি সময়েই উদ্যাপিত হয়ে আসছে। আমরা আমাদের উত্সবগুলির ‘বহুমুখী বৈচিত্র’ উপভোগ করি, কিন্তু আমরা আবার একটা অলিখিত বোঝাপড়া করে নিয়েছি যে, কয়েকটি দিনের মধ্যেই আমরা সেই উত্সব করব। বিভিন্ন আঞ্চলিক উত্সবকে সময়ের দিক থেকে একটা শৃঙ্খলায় আনার এই প্রক্রিয়াটি প্রায় দুই সহস্রাব্দের নিরন্তর বিবর্তনের পরিণাম। এ বিষয়ে ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। হোলি, দেওয়ালি, নবরাত্রি, দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে বিভিন্ন সর্বভারতীয় উত্সবে এই প্রক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে।
যেমন মকর সংক্রান্তি। সাধারণত ১৪ জানুয়ারি বা তার এক দিন আগে-পরে এই তিথি আসে। তবে বিভিন্ন অঞ্চলে এই উত্সবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, তার মেয়াদও আলাদা হয়ে থাকে, কোথাও কোথাও চার দিন অবধি উত্সব চলে। বাংলায় পৌষ সংক্রান্তি, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ ও জম্মুতে লোহ্রি, কর্নাটকে মকর সংক্রমণ, কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত। উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চল, ওডিশা, মহারাষ্ট্র, গোয়া, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা এবং কেরলে মকর সংক্রান্তি নামটিই চলে, যদিও তার পাশাপাশি স্থানীয় নামেরও প্রচলন আছে, যেমন মধ্যপ্রদেশে সুকরাত বা বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের কোনও কোনও এলাকায় খিচড়ি পর্ব। অন্য দেশেও হিন্দুধর্ম প্রভাবিত উত্সবের বহুমুখী ঐক্য আছে, যেমন নেপালে এই সময়ে মাঘে সংক্রান্তি পালিত হয়, তাইল্যান্ডে সোংক্রান, কাম্বোডিয়ায় মোহা সোংক্রান, মায়ানমারে থিংইয়ান, লাওস-এ এর নাম হল পি মা লো।
কিন্তু এই দিনটির মাহাত্ম্যটা কী? রাশিচক্রের বিচারে এই তিথিটিতে সূর্য মকর রাশিতে (ক্যাপ্রিকর্ন) প্রবেশ করে। লক্ষণীয়, এখন এই তিথিটা পড়ছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ১৪ জানুয়ারির আশেপাশে, কিন্তু এক হাজার বছর আগে মকর সংক্রান্তি হত ৩১ ডিসেম্বর নাগাদ, আবার এক হাজার বছর পরে সেটি ফেব্রুয়ারিতে সরে যাবে। এই তিথিতে বাংলা বছরের ‘অশুভ’ পৌষ মাসের অবসান হয়, আবহাওয়ার দিক থেকে দেখলে ধরে নেওয়া হয় যে, এর পর শীতের প্রকোপ কমে আসবে। ভারতের উত্তরের দেশগুলিতে ২২ বা ২৩ ডিসেম্বরের সময়টি খুব আনন্দ-উচ্ছ্বাসে পালিত হয়, কারণ ওই সময়েই সূর্য উত্তরে যাত্রা শুরু করে, যার নাম সূর্যের উত্তরায়ণ, ফলে ঠান্ডা কমতে থাকে। এবং এটাই হল খ্রিস্টপূর্ব যুগের ইয়ুলটাইড উত্সব, পরে ক্রিসমাস যাকে গ্রাস করে নেয়!