ফাল্গুন মাসে কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী/চতুর্দশীর রাত্রি এ দেশের লক্ষ লক্ষ ভক্তের কাছে পরম পবিত্র। আসলে সারা বছরে শিবরাত্রির সংখ্যা বারো, কিন্তু ফাল্গুনের এই তিথিটিই সবচেয়ে পবিত্র বলে গণ্য হয়। অনেকে বলেন, এই দিনটিতেই শিব লিঙ্গরূপে প্রথম প্রকাশ পেয়েছিলেন। পুরাণে আছে, এই দিন শিব ও পার্বতীয় বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী? বিয়ে তো কত লোকেই করে, এবং হরপার্বতীর বিয়েতে ঝঞ্ঝাট হয়েছিল বটে, কিন্তু অনেকের বিয়েতেই বিপুল ঝঞ্ঝাট হয়। এই দিনটার এমন অস্বাভাবিক মাহাত্ম্য কেন? বলা হয়, উত্তর গোলার্ধের আকাশে এই দিনটিতে গ্রহ-নক্ষত্রের সংস্থান এমন হয়, যাতে মানুষ তার আধ্যাত্মিক এবং অন্যান্য শক্তি বিশেষ ভাবে জাগ্রত করে তুলতে পারে। শিব নিজে নাকি উমাকে বলেছিলেন, এই তিথি পালন করলে সমস্ত পাপের ফল থেকে নিষ্কৃতি মিলবে এবং মোক্ষলাভ হবে। অনেকের বিশ্বাস, শিবরাত্রিতে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র ইত্যাদি পাঠ করলে সত্যি সত্যিই শক্তি বাড়ে। এই লেখায় আমরা অবশ্য শিবরাত্রির আচার অনুষ্ঠান মন্ত্রতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করব না। আমরা বোঝার চেষ্টা করব, বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে শিবরাত্রি কেন এতটা মহিমা অর্জন করল?
আমার মতো গবেষকদের কাছে শিব আজও অতি আকর্ষণীয় এক দেবতা। বস্তুত, যে সব ইংরেজি-জানা শহুরে তরুণ ‘দেশি’ সংস্কৃতি এবং ধর্ম থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে, তারাও এখন শিবের প্রবল অনুরাগী হয়েছে, অনেকটাই আমিশ ত্রিপাঠীর ‘শিব ট্রিলজি’র কল্যাণে। একটা ব্যাপার আমাকে চিরকালই বেশ অবাক করেছে: এই দেবতাটি পরনে একখানা বাঘছাল জড়িয়ে কী ভাবে হিমালয়ের ওই ঠান্ডা সামলান। আর, যে বাঙালি তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রির নীচে নামলেই তড়িঘড়ি মাফলার এবং মাঙ্কি ক্যাপ জড়িয়ে ফেলে, শিব তাদের এমন প্রিয় হন কী করে, সেটাও কম রহস্য নয়। শিবের মাহাত্ম্যের অন্য দিকও ভুললে চলে না। হিন্দুদের আদি ত্রিমূর্তির মধ্যে ব্রহ্মা সেই কোন কালে গুরুত্ব হারিয়েছেন, তাঁর জন্য সাকুল্যে পুষ্করে একটি মন্দির বরাদ্দ। বিষ্ণু দশাবতারের ছকটির কল্যাণে নিজের একটা ব্যবস্থা করেছেন। শিবের আসন কিন্তু খুবই পাকা। তিনি এমনকী দেবরাজ ইন্দ্রকেও হারিয়ে দিয়েছেন— বেচারি ইন্দ্র এখন নানান নামের শেষাংশ হয়ে টিকে আছেন, যেমন নরেন্দ্র। বস্তুত, শিবের সাম্রাজ্য ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে: তিব্বত তথা চিনের মানসরোবর থেকে ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে কন্যাকুমারী পর্যন্ত। দেশ জুড়ে বিস্তৃত তাঁর এক ডজন জ্যোতির্লিঙ্গ, কেদারনাথ থেকে সোমনাথ, বৈদ্যনাথ থেকে কাশী বিশ্বনাথ, দক্ষিণে রামেশ্বরম, আবার ও দিকে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ এবং অন্য নানা রাজ্যে তিনি পূজিত।
শিব বরুণ বা ইন্দ্রের মতো বৈদিক দেবতা নন বটে, কিন্তু শিবরাত্রি বহু যুগ ধরে পালিত হয়ে এসেছে। শিবের প্রাচীনতা প্রমাণ করার জন্য ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা চিত্রভানুর কথা বলা হয়, বলা হয় ঈশান সংহিতার কথাও। বিভিন্ন পুরাণের উল্লেখ তো আছেই: শিবপুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, মত্স্যপুরাণ, বায়ুপুরাণ ইত্যাদি। কিন্তু এগুলিতে সাধারণ ভাবে শিবের মাহাত্ম্যের কথা আছে, নির্দিষ্ট ভাবে শিবরাত্রির কথা নয়। এই প্রসঙ্গে জন মার্ডক-এর কথা বলা দরকার। ভারতবর্ষের বিভিন্ন উত্সব সম্পর্কে উইলসন, ক্রুক, হিউজ এবং উইলকিনস যে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, মার্ডক সেগুলি এক জায়গায় সংকলিত করেন। শিবরাত্রি সম্পর্কে ১৯০৪ সালে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রাচীন বলে কীর্তিত হলেও স্পষ্টতই এটি আসলে নিতান্ত অর্বাচীন।’ বস্তুত, অনেক দেবতাই প্রাচীন হতে পারেন, কিন্তু তাঁদের উপাসনার পদ্ধতি হয়তো অনেক সাম্প্রতিক। যেমন আমাদের বারোয়ারি দুর্গোত্সব কিংবা মহারাষ্ট্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় গণেশ চতুর্থী, দুটিই মোটামুটি একশো বছরের পুরনো। তবে অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে লেখা আব্বে দুবোয়ার প্রসিদ্ধ ‘হিন্দু ম্যানার্স, কাস্টমস অ্যান্ড সেরিমনিজ’ গ্রন্থে শিবরাত্রির উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতে প্রাচীন শব্দটি বেশ ঠিলেঠালা ভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত করে ধরে নিতে পারি যে, শিবরাত্রি অন্তত দুশো বছর পালিত হচ্ছে, এবং বিভিন্ন উত্সবের সঙ্গে তুলনা করলে দুশো বছর খুব কম সময় নয়।