Advertisement
০১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

সরকার বনাম মিডিয়া: একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধকাহিনি

এনডিটিভি ইন্ডিয়া-র সম্প্রচার এক দিনের জন্য বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু ঘাড় বাঁকা করে দাঁড়াল মিডিয়া। ফল, নির্দেশ আপাতত স্থগিত। সাংবাদিকরা কি এ যুদ্ধে সত্যিই ঐক্যবদ্ধ ছিল?জিতল কে? মোদী সরকার না মিডিয়া? ইস্কুলের হেড মাস্টারমশাই যেমন দুষ্টু ছেলেকে এক দিনের জন্য সাসপেন্ড করেন, সেই ধাঁচে মিডিয়াকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল কেন্দ্র।

দুই পক্ষ। নয়া দিল্লিতে বিজেপি-র মঙ্গল মিলন সমারোহে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাংবাদিকরা। ছবি: পিটিআই

দুই পক্ষ। নয়া দিল্লিতে বিজেপি-র মঙ্গল মিলন সমারোহে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাংবাদিকরা। ছবি: পিটিআই

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০২
Share: Save:

জিতল কে? মোদী সরকার না মিডিয়া? ইস্কুলের হেড মাস্টারমশাই যেমন দুষ্টু ছেলেকে এক দিনের জন্য সাসপেন্ড করেন, সেই ধাঁচে মিডিয়াকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল কেন্দ্র। দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করায় হিন্দি সংবাদের চ্যানেল এনডিটিভি ইন্ডিয়া-র সম্প্রচার এক দিনের জন্য বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল। মাঝেমাঝে মিডিয়া ‘আচ্ছা স্যর’ বলে ঘাড় কাত করে বটে, কিন্তু এ বার ঘাড় বাঁকা করে দাঁড়াল। কয়েক রাউন্ড স্নায়ুযুদ্ধ হয়ে গেল দু’পক্ষে। কাগজে, চ্যানেলে বিতর্ক, নানা শহরে সাংবাদিকদের মিটিং-মিছিল, ৯ নভেম্বর সব চ্যানেল বন্ধ রাখার প্রস্তাব, সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন। শেষ অবধি ভারতীয় মিডিয়ার ‘কালা দিবস’ এড়ানো গিয়েছে। সম্প্রচার বন্ধের নির্দেশ আপাতত স্থগিত।

মিডিয়ার অবস্থান কোথায়, গণতন্ত্রে সেটাও দরকারি প্রশ্ন। ‘এ কেমন সরকার’ বলে হট্টগোল জোড়া যায় যদি, ‘এ কেমন মিডিয়া’ প্রশ্নটাও করতে হবে বইকী। এই চ্যানেল-নিষেধাজ্ঞা বিতর্কটা ছোট্ট পরিসরে তার একটা ছবি তুলে ধরছে। দেখা যাচ্ছে, ‘দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে সরকার চ্যানেল তুলে দিতে পারে’ আর ‘সরকার কখনওই মিডিয়ার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না,’ এমন দুটো বিপরীত অবস্থানের মধ্যে বিভিন্ন বিন্দুতে রয়েছে নানা কাগজ, চ্যানেল, ডিজিটাল মিডিয়া।

এক প্রান্তে রয়েছে সাংবাদিক সংগঠনগুলি। এডিটর্স গিল্ড প্রায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলে, চ্যানেল বন্ধের নির্দেশ বাক্-স্বাধীনতার অধিকার ভঙ্গ, নাগরিকের অধিকারে আঘাত। জাতীয় প্রেস ক্লাব, সাংবাদিকদের একাধিক ইউনিয়ন, ইন্ডিয়ান উইমেন্স প্রেস কোর, এডিটর্স গিল্ড, এমন নানা সংগঠনের একটি সংযুক্ত বিজ্ঞপ্তিতে বিপদের চেহারাটা আরও স্পষ্ট করে বলা হল, ‘এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে কেন্দ্রীয় সরকার এই চূড়ান্ত পদক্ষেপ করছে এমন সময়ে, যখন দেশজুড়ে মিডিয়ার স্বাধীনতা আক্রান্ত। এটা সারা দেশের সংবাদমাধ্যমকে একটা বিপদসংকেত পাঠাচ্ছে।’

চ্যানেল বন্ধ মানে বাক্-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, এই আপত্তি যাঁরা তুলেছেন তাঁরা প্রায় সকলেই ইমার্জেন্সির প্রসঙ্গ এনেছেন। তীব্র সমালোচনা উঠে এসেছে লেখক-গবেষক প্রতাপভানু মেটা-র কলমে। এক ইংরেজি দৈনিকে লিখছেন, মোদীর জমানা ইমার্জেন্সির চেয়েও ভয়ঙ্কর, কারণ নিয়ন্ত্রণ এখন এমন গভীরে যে তাকে ইমার্জেন্সি বলে চেনা যাচ্ছে না। বিরোধীদের অচল করা, ‘জাতীয়তাবাদ’ ব্যবহার করে কণ্ঠরোধ করা, গো-রক্ষার নামে নির্যাতন, নিরাপত্তার নামে নজরদারি এখন প্রশাসনের রুটিন কাজ বলে মনে হচ্ছে। সেই সঙ্গে, সেন্সরশিপ প্রয়োগ না করেও মিডিয়ার থেকে কতখানি বাধ্যতা আদায় করা যায় এই সরকার তা-ও দেখিয়েছে। ‘এটা তো ইমার্জেন্সি নয়। মিডিয়া এখন স্বেচ্ছায় নতিস্বীকার করছে।’ অনেকেই উল্লেখ করেছেন যে একটি চ্যানেলে এক প্রাক্তন মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার বিজ্ঞাপিত হয়েও প্রচারিত হয়নি। সরকার ও সেনাবাহিনীর কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না, চ্যানেল-কর্তারা ইমেল করে বলেছিলেন সাংবাদিকদের।

সরকারের সঙ্গে স্বেচ্ছা-সহমতের কারণেই হোক বা অন্য কারণে, সাংবাদিকরা প্রতিবাদে যতটা উচ্চকিত তাঁদের চ্যানেল-কাগজ ততটা নয়। বেশ কিছু সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় কিংবা উত্তর সম্পাদকীয়তে বক্তব্য এই রকম: দেশের নিরাপত্তা সরকারের দায়িত্ব, দরকার হলে তার জন্য মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বইকী। তবে মিডিয়ার উপর নজরদারির জন্য কত রকম কাউন্সিল আছে। প্রাক্তন বিচারপতিদের দিয়ে কমিটি করা যেত। সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপ ঠিক নয়। কয়েকটি কাগজ-ওয়েবসাইটে প্রবন্ধ লেখা হল সম্প্রচার আইনের ফাঁকফোকর নিয়ে। আইন দুর্বল বলেই সরকার নাক গলাতে পারছে, আইন বদলানো দরকার। মানে সমস্যাটা নীতিগত নয়, পদ্ধতিগত।

এই লাইন ধরে এগোলে কোথায় পৌঁছতে হবে, তার নিদর্শন একটি সংবাদ ওয়েবসাইটে আরিহন্ত পানাগরিয়ার নিবন্ধ। তাঁর বক্তব্য, একে কখনওই ইমার্জেন্সির সঙ্গে তুলনা করা যায় না, কারণ চ্যানেলকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্য। সরকার-বিরোধিতার জন্য নয়। নিরাপত্তা ভাঙলে শাস্তি কি প্রাপ্য নয়? সরকারকেই কি সে শাস্তি দিতে হবে না?

কোনটা সংকট, কে কাকে সংকটে ফেলছে— তা নিয়ে দু’পক্ষের প্রেক্ষিত আলাদা হয়ে যাচ্ছে বলে অবস্থানও ভিন্ন। সরকারের চোখে প্রেক্ষিত: সন্ত্রাস। কার্গিল যুদ্ধ, মুম্বইতে সন্ত্রাসবাদী হানা, পঠানকোট, প্রতি বার চ্যানেলের খবরে সেনার বিপদ হয়েছে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নাইডু প্রশ্ন করেছেন, ‘দেশের নিরাপত্তা বড় না টিআরপি়?’ দেশের মানুষ এ বিষয়ে সরকারকে সমর্থন করছেন, দাবি করেছেন নাইডু।

সাংবাদিকদের চোখে প্রেক্ষিত: সেন্সরশিপ। কাশ্মীরে কয়েক সপ্তাহ কাগজ, ইন্টারনেট অচল ছিল। কাশ্মীর টাইম‌্স বন্ধ করা হয়েছে। ছত্তীসগঢ়ে সাংবাদিকদের নামে মামলা, গ্রেফতার চলছে। জেএনইউ-র ছাত্রদের মামলার খবর করতে গিয়ে পাটিয়ালা হাউজ কোর্টে সাংবাদিকরা প্রচণ্ড মার খান। চ্যানেল বন্ধ করার প্রতিবাদে বারোটি ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম এক সংযুক্ত বিজ্ঞপ্তিতে লিখছে, ‘...সংবাদমাধ্যমকে চুপ করানোর ও নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা অটুট রয়েছে, তার প্রয়োগের ইচ্ছাও সরকারের রয়েছে ষোলো আনা।’

এই বিজ্ঞপ্তিতে একটি আত্মসমালোচনার সুরও রয়েছে: ‘গত কয়েক বছর ছত্তীসগঢ়, কাশ্মীর, অসম এবং কেরলে মিডিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত হয়েছে বা সামান্য ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এতে হয়তো কর্তাব্যক্তিরা উৎসাহিত হয়েছেন আরও সংবাদ সংস্থার উপর চাপ দিতে। আমরা সব ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করিনি, তার দায় আমাদের নিতে হবে। এখন আমরা সে ভুলের প্রতিকার করতে চাই।’ এই সমালোচনার সুর শোনা গিয়েছে এক সম্পাদকের গলায়। একটি অনুষ্ঠানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সামনে বলেন, সরকারের তিরস্কার যে সাংবাদিকদের পুরস্কার, তা যেন তারা না ভুলে যায়।

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেন্সরশিপের এই প্রেক্ষিত আরও ব্যাপক, আরও বিস্তৃত। এ কেবল ভারতে সীমিত নয়। দু’দশক চলার পর কাঠমান্ডু থেকে প্রকাশিত দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক একটি ম্যাগাজিন বন্ধ হয়ে গেল, কারণ বিদেশি টাকার নিয়ন্ত্রণের আইন খাটিয়ে তাদের অনুদান আটকে রাখা হয়েছে ব্যাংকেই। বাংলাদেশের একটি প্রধান কাগজের সম্পাদকের বিরুদ্ধে ৮৪টি মানহানির মামলা, তার মধ্যে ১৮টি রাষ্ট্রদ্রোহিতার। মলদ্বীপে রাষ্ট্রদ্রোহিতার যে আইন পাশ হয়েছে, তাতে কার্যত বিরোধীদের সমাবেশ, বক্তৃতা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সাংবাদিকদের গ্রেফতার, তল্লাশির নামে ঢুকে সংবাদমাধ্যমের অফিসে ভাঙচুর করছে পুলিশ। গোপন বৈঠকে সেনা-প্রশাসনের সংঘাতের কথা ফাঁস করায় পাকিস্তানের সাংবাদিক সিরিল আলমেইদাকে দেশের বাইরে ভ্রমণের অনুমোদন খারিজ করেছিল পাক সরকার। দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না নেতারা, বেসরকারি সংস্থাকেও চাপ দিচ্ছেন বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে। পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ দিয়ে সংবাদপত্রের মালিক, প্রকাশকের উপর নজরদারি চলছে। আঘাত পেলে প্রত্যাঘাত, এই নিয়মকে মিডিয়া-সরকার সম্পর্কেও ‘নিউ নর্মাল’ করে তুলতে চাইছে বহু দেশের সরকার, ঢাকায় একটি সাংবাদিক সম্মেলনে সম্প্রতি বলছিলেন ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের বারবারা ত্রিনোফি। ‘সাংবাদিকতায় ঝুঁকি থাকতে পারে, কিন্তু সাংবাদিককে বিপদে পড়তেই হবে এটা ধরে নেওয়া চলে না,’ বলেন তিনি। তাঁর মতে, গোটা বিশ্বে এই মনোভাব মাথা চাড়া দিচ্ছে।

ভারতে এক প্রবীণ সাংবাদিকও এক বার ব্যাখ্যা করেছিলেন, রাষ্ট্র যে ভাবে চাপ তৈরি করে, তার পদ্ধতি কী ভাবে পালটেছে। প্রথম যুগে বলা হত, কথা না শুনলে বাদ। ইন্টারভিউ পাবে না, অনুষ্ঠানে ডাক পাবে না। তার পর এল ভয় দেখানো— রিপোর্ট বদলান, নইলে চ্যানেল বন্ধ করব। এ বার শুরু হয়েছে সরকারি দফতরকে কাজে লাগিয়ে নিয়ন্ত্রণ। আয়করের হানা, মিথ্যা মামলা, সরকারি অনুমোদন বাতিল। ‘এ-ও চলে যাবে,’ বলেছিলেন ওই সাংবাদিক।

যাবে হয়তো, কিন্তু সহজে যাবে না। একটি নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকরা সরকারের মুখোমুখি, সমানে-সমানে দাঁড়িয়ে আছে। এ-ও বদলাবে, নতুন সংকট নতুন বিপন্নতা তৈরি করবে। যার অনেকটাই থাকবে চোখের আড়ালে। তবু কিছু তো হল। সাংবাদিকরা এক পা পিছু হঠতে বাধ্য করেছেন সরকারকে। গণতন্ত্রে এই বা কম কী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Media
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE