Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

আরও হাজারটা আইসিস জন্মাতে পারত

সিরিয়ার আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ, সেখানে একনাগাড়ে এমনই অত্যাচার চালিয়ে এসেছেন প্রেসিডেন্ট আসাদ যে, নিষ্ঠুরতম জঙ্গিপনায় যোগ দিতে কারও বাধেনি।সিরিয়ার আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ, সেখানে একনাগাড়ে এমনই অত্যাচার চালিয়ে এসেছেন প্রেসিডেন্ট আসাদ যে, নিষ্ঠুরতম জঙ্গিপনায় যোগ দিতে কারও বাধেনি।

ক্ষুধার রাজ্যে। দরিদ্র কৃষকের মধ্যেই আইসিসের সমর্থন। ইরাক, জুন ২০১৫। ছবি: এপি।

ক্ষুধার রাজ্যে। দরিদ্র কৃষকের মধ্যেই আইসিসের সমর্থন। ইরাক, জুন ২০১৫। ছবি: এপি।

প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

ই স্তিকলাল অ্যাভিনিউকে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন ইস্তানবুলের ফিফথ অ্যাভিনিউ। অল্প বাড়াবাড়ি, তবু এর থেকে জায়গাটির একটা আঁচ পাওয়া যায়। চওড়া রাস্তার দু’ধার জুড়ে ব্র্যান্ডেড দোকানের সার, মাথার ওপর দিয়ে লাইন করে ইলেকট্রিক বোর্ড, সন্ধ্যা হলেই সেখানে আলোর কারুকাজ, অগুন্তি ট্যুরিস্ট দিন নেই রাত নেই হেঁটে বেড়াচ্ছেন, সারা বছর ধরেই বেশ উৎসব উৎসব ভাব। কিন্তু ইদানীং ও চত্বরে গেলেই যেন তাল কেটে যাচ্ছে, কয়েক হাত অন্তর নির্বাক মহিলারা হাত বাড়িয়ে রয়েছেন কিছু সাহায্য পাওয়ার আশায়, সঙ্গে ছোট ছেলেমেয়ে। কখনও হয়তো শুনবেন ভিক্ষাপ্রার্থী কেউ অ্যাকর্ডিয়ানে রুশ লোকগীতির সুর তুলছেন, কিন্তু বেশির ভাগই বিনা অভিব্যক্তিতে মাথা নিচু করে বসে, যেন জীবন নিয়ে অভিযোগ করার সামান্যতম স্পৃহাটুকুও চলে গেছে। এঁরা সিরিয়ার উদ্বাস্তু, তুরস্ক সরকারের কড়াকড়ি সত্ত্বেও সিরিয়ার সীমান্তসংলগ্ন শহরগুলি থেকে চোখ এড়িয়ে পৌঁছে গেছেন ইস্তানবুলে। এই মুহূর্তে প্রায় পনেরো লাখের কাছাকাছি সিরীয় আশ্রয় নিয়েছেন তুরস্কে। অবর্ণনীয় কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা, মাথা গোঁজার জায়গাটুকুই পেয়েছেন। সিরিয়ার আসাদ সরকারের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী এবং ইসলামিক স্টেট বা আইএস তথা আইসিস-এর অত্যাচার থেকে বাঁচতে প্রতিদিন আরও অজস্র মানুষ সীমানা পেরিয়ে ঢুকছেন।

২০১৪-র গ্রীষ্মকালের আগে বাকি পৃথিবী আইসিসের নামই শোনেনি। এক বছরের মধ্যে এদের কুখ্যাতি প্রায় সর্বজনবিদিত। আচম্বিতে এহেন জঙ্গি সংঠনের উদ্ভব হল কী ভাবে? ওদের নেতা আবু বকর আল বাগদাদি এমন কী মন্ত্র জানে? সংক্ষিপ্ত উত্তর, বাগদাদি এক সুযোগসন্ধানী মানুষ। ২০১১ কি তারও আগে থেকে সিরিয়ার আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এত দ্রুত খারাপ হতে শুরু করেছে যে, এরকম হাজারটা আইসিসের জন্ম হতে পারত। বাগদাদি প্রথম ব্যক্তি, যে সুযোগটা নিতে পেরেছে।

আইসিসের তরুণ জঙ্গিরাও মানুষ, এ কথাটা ভাবা দুষ্কর, জন্ম ইস্তক তারা এতটাই নিষ্ঠুর কার্যকলাপে অভ্যস্ত। সারা পৃথিবীর টিনএজারদের মতোই এদেরও নিজস্ব চাহিদা, স্বাদ-আহ্লাদ আছে। ধর্ম এদের অনেকের কাছেই একটা বিমূর্ত, ভাসা ভাসা ধারণা। তা হলে কেন এরা শামিল হচ্ছে এই অভূতপূর্ব সন্ত্রাসে?

২০১৪-র অনেক আগে থেকেই সিরিয়া ব্যর্থ রাষ্ট্রদের একেবারে ওপরের তালিকায়। ব্যর্থ রাষ্ট্ররা কীসে ব্যর্থ? প্রায় সব কিছুতেই। তারা দেশবাসীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারে না, খাদ্যদ্রব্য বা ওষুধ দিতে অপারগ, কাজের সুযোগ তৈরি করা দূরস্থান, উলটে থেকে যাওয়া কাজগুলোকেই বরবাদ করে বসে, এবং প্রায় নিয়ম করে রক্তক্ষয়ী জাতিগত দাঙ্গার পথ সুগম করে দেয়। সিরিয়ার আসাদরা পুরুষানুক্রমে একনায়কতন্ত্র চালিয়ে এসেছেন। অর্থনৈতিক প্রগতি আসেনি, বৈষম্য বেড়েছে, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার চরম অভাব দেখা দিয়েছে, মানুষের হতাশা ক্রমশই বেড়েছে। ততই মজবুত হয়েছে জাতিগত বিভেদ। মানুষের ক্ষোভ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারও যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছে। নিজের দেশের মানুষকে দমাতে অকল্পনীয় পরিমাণ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে গত চার-পাঁচ বছরে, এবং যে বর্বরতার পরিচয় এই সরকার দিয়েছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

একই ধর্মাবলম্বী এবং একই দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বও সিরীয় কুর্দদের সঙ্গে সিরীয় আরবদের লড়াই বেঁধেছে। যে জায়গায় কুর্দ ভূস্বামীর প্রতিপত্তি বেশি, সেখানকার আরবরা নিজেদের শোষিত ভাবছেন। উল্টোটা ঘটেছে যখন আরবদের হাতে ক্ষমতা থেকেছে। প্রেসিডেন্ট আসাদ নিজে শিয়া, তাই প্রথমে বিক্ষুব্ধ এবং পরে আইসিসের সঙ্গে লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গে থেকেছে সিরিয়ার শিয়ারা। শিয়াপ্রধান দেশ ইরান জুগিয়েছে লোকবল, অর্থবল। সুন্নি আরবরা আবার কতকটা আসাদের পতন ঘটাতে, কতকটা কুর্দদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে একচেটিয়া সমর্থন জানিয়েছে আইসিসকে। এ দিকে সিরিয়ার পাশের দেশ তুরস্কের নিজের তাগিদেই উচিত ছিল আইসিসের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ তৈরি করা, কিন্তু মুশকিল বাধিয়েছে তুর্কি এবং কুর্দদের মধ্যে ঐতিহাসিক বিরূপতা। ফলে আইসিসের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সক্রিয়তার নামমাত্রই তুরস্ক এত দিনে দেখাতে পেরেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে ইসলামিক স্টেট বাকি ধর্মের মানুষগুলিকে খুন করে যাচ্ছে। স্বভাবতই খ্রিস্টপ্রধান রাষ্ট্রগুলি উত্তেজিত। কুর্দদের সমরবল জোগাতে আসরে তাই উপস্থিত ফ্রান্স, জার্মানি সহ ইউরোপীয় দেশ।

এই একাধিক সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থাহীনতার মুনাফা তুলেছে আইসিস। আইসিসের উৎপত্তি কিন্তু সিরিয়ার মাটিতে নয়, বরং পাশের দেশ ইরাকে। সাদ্দাম হোসেনের সরকার উৎখাত হওয়ার পর বকলমে মার্কিন শাসন চালু হওয়ার সময় থেকেই ইরাকে গড়ে ওঠে একাধিক মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠন, যাদের অন্যতম ছিল ‘আল কায়দা ইন ইরাক’ (একিউআই)। ২০০৩ থেকেই এই সংগঠনটি ইরাকে সন্ত্রাসবাদী কাজ চালিয়ে আসছিল, ২০০৬ সালে আমেরিকা ইরাকের একাধিক জনজাতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে গোষ্ঠীটিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়, মার্কিন বিমানবাহিনীর আক্রমণে মারা যায় এদের নেতা আবু মুসাব আল-জারকাওয়ি। একিউআই ধবংস হওয়ার পর উঠে আসে অজস্র নতুন জঙ্গি সংগঠন। ইরাকের জেলগুলি ছিল এদের কাজকারবারের মূল ঘাঁটি। ইরাক থেকে আমেরিকা সৈন্য সরিয়ে নিতে থাকায় এদের কাজ আরও সহজ হয়ে যায়। আর এই সময়েই একিউআই-এর পুরনো কমরেডদের ফের একত্রিত করে নতুন ব্র্যান্ডিং-এ আবির্ভূত হয় ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড আল-শাম’, সংক্ষেপে আইসিস, আর তার সর্বেসর্বা আল-বাগদাদি।

নতুন ব্র্যান্ডিং-এ পুরনো পণ্যই চালালে মানুষের আস্থা অর্জন করা কঠিন। কিছু তফাত, কিছু উন্নতি দেখানো একান্ত দরকার। আল-বাগদাদির আইসিস তাই নিজেদের আলাদা করে নেয় অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলির থেকে, এবং সেটা এতটাই সাফল্যের সঙ্গে করে যে, বহু পশ্চিমী বিশেষজ্ঞও বলতে শুরু করেন আইসিসকে আল-কায়দার মতো আর একটা জঙ্গি সংগঠন বলা ঠিক হবে না। আল কায়দার মতো সংগঠনগুলি প্রায় সবসময়ই চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়েছে, সন্ত্রাস ঘটিয়েছে আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন শহরে, কিন্তু নিজের সৈন্যবাহিনী তৈরি করেনি, দখল করার চেষ্টা করেনি কোনও রাষ্ট্রের অংশ, সরাসরি সামরিক সংঘাতে যায়নি বা স্থানীয় অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের উৎসাহ দেখায়নি। আর আইসিস ঠিক এই কাজগুলোই করেছে। পশ্চিমের বদলে তাদের কার্যকলাপের অভিমুখ থেকে গেছে পূর্বে। তাই আজ আইসিস সাধারণ সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর থেকে বেশ কিছুটা আলাদা, হয়তো বলা যেতে পারে, এটি একটি ছদ্ম-রাষ্ট্রশক্তি, যার পরিচালনার ভার সম্পূর্ণ ভাবে ন্যস্ত তার সৈন্যবাহিনীর ওপর।

শুধু অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা নয়, আমেরিকা বা ইউরোপের ব্যর্থ বিদেশ নীতিও আইসিসের উত্থানে অনুঘটকের কাজ করেছে। এই দেশগুলি ভেবেছিল, গদ্দাফির মতোই আসাদের পতনও অবশ্যম্ভাবী। ইরান ও রাশিয়ার পরোক্ষ সমর্থনে আসাদ সরকার যে টিকে যাবে সেটা হিসাবের মধ্যে ছিল না। ইরানের ক্ষেত্রে ধর্ম বড় ভূমিকা নিয়েছে, রাশিয়ার আবার ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ নীতি। সিরিয়ার মানুষও ভেবেছিলেন সিরিয়ার বসন্ত বিপ্লব তাঁদের দীর্ঘকালীন দুর্দশা থেকে মুক্তি দেবে। সে আশা অচিরে বিনষ্ট হয়।

গণতন্ত্র ও কূটনীতির যুগপৎ ব্যর্থতাতেই আইসিসের পক্ষে কাজটা সহজ হয়ে গেছে। মানুষ শেষে ভেবেছেন প্রাণধারণের নিশ্চয়তা পেলে হয়তো ব্যক্তিস্বাধীনতা জলাঞ্জলি দেওয়াই যায়। এই পরিস্থিতিতে সিরিয়ার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ শহরের নিয়ন্ত্রণ আইসিসের হাতে চলে গেছে। ঘরে বাইরে কোনও সাহায্য না পেয়ে তরুণ সিরীয়দের একটা বড় অংশ নিজে থেকেই চলে গেছে আইসিসের দরজায়। করুণতর উপসংহার হয়তো অদূরেই অপেক্ষা করে আছে: আইসিসকে কেন্দ্রে রেখে আরও বড়, আরও রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ শুধু সময়ের অপেক্ষা।

ইস্তানবুলের সাবাঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট-এ শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE